শিশুর খাবারে অ্যালার্জি: কারণ, লক্ষণ ও ঝুঁকিপূর্ণ খাবারগুলোর তালিকা

শিশুর অ্যালার্জির লক্ষণ ও প্রতিকার: ডাক্তারদের পরামর্শ অনুযায়ী করণীয়

 

শিশুর খাবারে অ্যালার্জি – কোন খাবারগুলি ঝুঁকিপূর্ণ?

শিশুর খাবারে অ্যালার্জির সাধারণ কারণ

শিশুরা যখন নতুন খাবারের সাথে পরিচিত হয়, তখন তাদের ইমিউন সিস্টেম কখনো কখনো সেই খাবারকে ক্ষতিকর বলে ভুল করতে পারে। এতে তাদের শরীরে অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।

শিশুর খাদ্য-সংক্রান্ত অ্যালার্জির পেছনে বেশ কিছু কারণ কাজ করে, যেমন:

  • জিনগত কারণ – পরিবারের কারও যদি অ্যালার্জি থাকে, তবে শিশুরও সেই ঝুঁকি বেশি থাকে।
  • পরিবেশগত কারণ – দূষিত পরিবেশ ও অপরিচ্ছন্ন খাবার থেকেও অ্যালার্জি হতে পারে।
  • ইমিউন সিস্টেমের প্রতিক্রিয়া – শিশুর শরীর কিছু নির্দিষ্ট প্রোটিনকে ক্ষতিকর ভাবতে পারে, ফলে প্রতিরোধ ব্যবস্থা সক্রিয় হয়।

শিশুর খাবারে সাধারণ অ্যালার্জেন

১. গরুর দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য

গরুর দুধ শিশুদের মধ্যে অন্যতম সাধারণ অ্যালার্জেন। বিশেষ করে ১ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে দুধের প্রোটিন হজম করতে সমস্যা হয়, যা থেকে অ্যালার্জির লক্ষণ দেখা যায়।

২. বাদাম (চিনা বাদাম ও কাঠবাদাম)

বাদামজনিত অ্যালার্জি মারাত্মক হতে পারে এবং আজীবন স্থায়ী থাকতে পারে। চিনা বাদাম ও কাঠবাদামে প্রচুর প্রোটিন থাকে, যা ইমিউন সিস্টেমের অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়ার কারণ হতে পারে।

৩. ডিম

ডিমের সাদা অংশে থাকা প্রোটিন অনেক শিশুর জন্য অ্যালার্জির কারণ হতে পারে। তবে অনেক শিশুই বড় হওয়ার সাথে সাথে এই অ্যালার্জি থেকে মুক্তি পায়।

৪. গম ও গ্লুটেনযুক্ত খাবার

গমে থাকা গ্লুটেন নামক প্রোটিন অনেক শিশুর হজম প্রক্রিয়ায় সমস্যা তৈরি করতে পারে, যা থেকে অ্যালার্জি দেখা দেয়।

৫. সয়াবিন ও সয়া-ভিত্তিক খাবার

সয়াবিন এবং সয়া-ভিত্তিক খাবার শিশুর অ্যালার্জির কারণ হতে পারে, বিশেষত যারা গরুর দুধের প্রতি সংবেদনশীল।

৬. সামুদ্রিক খাবার (চিংড়ি, কাঁকড়া, মাছ)

সামুদ্রিক খাবার বিশেষত শেলফিশ, চিংড়ি ও কাঁকড়া শিশুর মধ্যে অ্যালার্জি তৈরি করতে পারে, যা কখনো কখনো মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।

শিশুদের মধ্যে অ্যালার্জির লক্ষণ

ত্বকের সমস্যা (চুলকানি, র‍্যাশ, একজিমা)

অ্যালার্জির ফলে শিশুর ত্বকে লালচে র‍্যাশ, চুলকানি ও একজিমার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।

হজমজনিত সমস্যা (বমি, ডায়রিয়া, পেট ব্যথা)

অ্যালার্জির কারণে অনেক শিশুর বমি, ডায়রিয়া বা পেট ব্যথার মতো সমস্যা হতে পারে।

শ্বাসকষ্ট (হাঁচি, কাশি, হাঁপানি)

অ্যালার্জির ফলে শ্বাসকষ্ট, নাক বন্ধ হওয়া, কাশি ও হাঁপানির মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।

অ্যালার্জি পরীক্ষা ও সনাক্তকরণ

শিশুর খাবারের অ্যালার্জি নিশ্চিত করতে বেশ কিছু পরীক্ষা করা হয়। ডাক্তাররা সাধারণত নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করে:

১. রক্ত পরীক্ষা

শিশুর রক্তে অ্যান্টিবডির (IgE) উপস্থিতি পরীক্ষা করে দেখা হয়, যা অ্যালার্জির অস্তিত্ব নির্ধারণে সহায়তা করে।

২. স্কিন প্রিক টেস্ট

এই পরীক্ষায় অ্যালার্জেনযুক্ত তরল শিশুর ত্বকের উপর প্রয়োগ করা হয় এবং প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করা হয়।

৩. এলিমিনেশন ডায়েট

শিশুর খাদ্য তালিকা থেকে সন্দেহজনক খাবারগুলি কিছুদিনের জন্য বাদ দেওয়া হয় এবং পর্যবেক্ষণ করা হয় যে লক্ষণগুলি কমছে কিনা। পরে সেই খাবার পুনরায় খাওয়ানো হলে যদি সমস্যা দেখা দেয়, তবে সেটি নিশ্চিতভাবে অ্যালার্জেন বলে ধরা হয়।

শিশুর খাবারের অ্যালার্জি প্রতিরোধের উপায়

১. নতুন খাবার পরিচিত করানোর নিয়ম

  • শিশুকে নতুন খাবার দেওয়ার সময় একবারে একটি খাবার দিন এবং তিন থেকে পাঁচ দিন পর্যবেক্ষণ করুন।
  • যদি কোনো খাবারের কারণে অ্যালার্জির লক্ষণ দেখা দেয়, তবে সেটি সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করুন।

২. সম্ভাব্য অ্যালার্জেন থেকে দূরে থাকা

  • শিশুর যদি কোনো নির্দিষ্ট খাবারে অ্যালার্জি থাকে, তবে সেই খাবার থেকে পুরোপুরি দূরে থাকতে হবে।
  • দোকান থেকে কেনা খাবারের লেবেল ভালোভাবে পড়তে হবে যাতে অ্যালার্জেন উপাদান আছে কিনা বোঝা যায়।

৩. প্রতিরোধমূলক পদ্ধতি

  • মায়ের দুধ খাওয়ানো শিশুর ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করতে সাহায্য করে এবং অ্যালার্জির ঝুঁকি কমাতে পারে।
  • গর্ভাবস্থায় মায়েরা অ্যালার্জেনযুক্ত খাবার খেলে শিশুর মধ্যে সহনশীলতা তৈরি হতে পারে।

শিশুর অ্যালার্জির চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা

১. খাদ্য পরিবর্তন

  • শিশুর খাদ্য থেকে অ্যালার্জেন সম্পূর্ণরূপে বাদ দিতে হবে।
  • বিকল্প পুষ্টিকর খাবার যোগ করা দরকার যাতে শিশুর পুষ্টির ঘাটতি না হয়।

২. চিকিৎসকের পরামর্শ

  • অ্যালার্জির লক্ষণ গুরুতর হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
  • কখনো কখনো অ্যান্টি-হিস্টামিন বা স্টেরয়েড ওষুধের প্রয়োজন হতে পারে।

৩. এপিনেফ্রিন ইনজেকশন ব্যবহারের নিয়ম

  • কিছু শিশুদের অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া মারাত্মক হতে পারে, যাকে অ্যানাফাইল্যাক্সিস বলা হয়।
  • এই ক্ষেত্রে জরুরি চিকিৎসার জন্য এপিনেফ্রিন অটো-ইনজেক্টর (EpiPen) ব্যবহার করা হয়।

অ্যালার্জি থেকে শিশুকে সুরক্ষিত রাখার উপায়

১. খাবারের লেবেল পড়ার গুরুত্ব

  • দোকানে কেনা প্যাকেটজাত খাবারের লেবেল ভালোভাবে পড়ে নিতে হবে।
  • "Contains allergens" বা "May contain traces of nuts" জাতীয় সতর্কতামূলক লেবেলগুলো খেয়াল করা জরুরি।

২. স্কুল ও পাবলিক প্লেসে সতর্কতা

  • স্কুল, ডে কেয়ার বা খেলার মাঠে শিশুর খাদ্য সম্পর্কে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের জানান।
  • অ্যালার্জির জরুরি অবস্থার জন্য কী করতে হবে, সে সম্পর্কে পরিচিতজনদের অবহিত করুন।

৩. শিশুর খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে সচেতনতা

  • শিশুকে ধীরে ধীরে শেখাতে হবে যে, কোন খাবার তার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
  • বাইরে থেকে খাবার কেনার আগে নিশ্চিত হতে হবে যে, সেটিতে কোনো অ্যালার্জেন নেই।

অ্যালার্জি সম্পর্কে সাধারণ ভুল ধারণা

১. শিশুর অ্যালার্জি চিরস্থায়ী নয়

  • কিছু অ্যালার্জি শিশুর বয়স বাড়ার সাথে সাথে কমে যায়। যেমন, অনেক শিশু ডিম ও দুধের অ্যালার্জি থেকে মুক্তি পায়।

২. সব শিশুর অ্যালার্জি একরকম নয়

  • কারও অ্যালার্জি হলে সেটি মারাত্মক হতে পারে, আবার কারও ক্ষেত্রে তা হালকা প্রতিক্রিয়াজনিত হতে পারে।

৩. অ্যালার্জি ও ল্যাকটোজ অসহিষ্ণুতা এক নয়

  • গরুর দুধের অ্যালার্জি ও ল্যাকটোজ অসহিষ্ণুতা আলাদা সমস্যা। ল্যাকটোজ অসহিষ্ণুতা হজম সংক্রান্ত সমস্যা, যেখানে দুধের অ্যালার্জি শরীরের ইমিউন প্রতিক্রিয়ার কারণে ঘটে।

উপসংহার

শিশুর খাবারে অ্যালার্জি একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে। তাই অভিভাবকদের উচিত শিশুর খাদ্যাভ্যাসের প্রতি সর্বদা সতর্ক থাকা। অ্যালার্জির লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। খাদ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা ও সচেতনতার মাধ্যমে শিশুকে সুস্থ রাখা সম্ভব।

About the author

Daud
Hey! I'm Daud, Currently Working in IT Company BD. I always like to learn something new and teach others.

Post a Comment

To avoid SPAM, all comments will be moderated before being displayed.
Don't share any personal or sensitive information.