এলার্জি থাকলে শিশুদের কোন ওষুধ খাওয়া যাবে না [Allergy Children]

এলার্জি থাকলে শিশুদের কোন ওষুধ খাওয়া যাবে না তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা। শিশুদের নিরাপত্তার জন্য ওষুধ নির্বাচনে সচেতনতা জরুরি
Allergy

শিশুদের ক্ষেত্রে ওষুধ বাছাই করার সময় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। কারণ শিশুদের শরীর অনেক বেশি সংবেদনশীল এবং প্রতিক্রিয়াশীল। বিশেষ করে যখন শিশুদের কোনো নির্দিষ্ট উপাদানে এলার্জি থাকে, তখন ভুল ওষুধ প্রয়োগের ফলে তা মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। এ ধরনের প্রতিক্রিয়া অনেক সময় শুধু ত্বকে চুলকানি বা র‍্যাশ নয়, বরং শ্বাসকষ্ট, বমি, এমনকি প্রাণঘাতী অ্যানাফাইল্যাক্সিস পর্যন্ত হতে পারে।

এলার্জি কি এবং শিশুদের ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব

এলার্জি হলো শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার একটি অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া যা কোনো নির্দিষ্ট খাবার, ওষুধ, ধুলাবালি, ফুলের রেণু বা রাসায়নিক পদার্থের সঙ্গে সংস্পর্শে এলে দেখা দেয়। শিশুদের ইমিউন সিস্টেম এখনো পরিপূর্ণভাবে গড়ে ওঠেনি, তাই তারা অনেক সহজেই এলার্জিতে আক্রান্ত হয়। শিশুদের ওষুধ গ্রহণে এলার্জি হলে এটি তাদের স্বাভাবিক শারীরিক ক্রিয়া ব্যাহত করতে পারে এবং তাৎক্ষণিক চিকিৎসা প্রয়োজন হয়।

শিশুদের কোন কোন ওষুধ এলার্জির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ?

নিচে কিছু সাধারণ ওষুধ ও ওষুধের গ্রুপ তুলে ধরা হলো, যেগুলো শিশুদের এলার্জির ঝুঁকি বাড়াতে পারে:

১. পেনিসিলিন ও অ্যান্টিবায়োটিক

পেনিসিলিন-ভিত্তিক অ্যান্টিবায়োটিক যেমন অ্যামোক্সিসিলিন, অ্যামপিসিলিন ইত্যাদি অনেক শিশুর জন্য এলার্জিক হতে পারে। এই ধরনের প্রতিক্রিয়ায় র‍্যাশ, চোখ মুখ ফুলে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, ও ক্লান্তি দেখা দিতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে এটি জীবনঘাতীও হতে পারে। চিকিৎসকরা সাধারণত পরীক্ষা করে বা ঐতিহাসিক তথ্য দেখে বিকল্প অ্যান্টিবায়োটিক নির্ধারণ করেন।

২. অ্যাসপিরিন ও স্যালিসিলেট

অ্যাসপিরিন শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কারণ এটি রেই’স সিনড্রোম নামক একটি প্রাণঘাতী সমস্যা তৈরি করতে পারে। স্যালিসিলেট জাতীয় ওষুধগুলোও এলার্জি প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষত যদি শিশুর আগে থেকে হাঁপানি বা ফুসফুসের সমস্যা থাকে।

৩. এনএসএআইডি (NSAIDs)

ইবুপ্রোফেন বা ন্যাপ্রোক্সেন জাতীয় ওষুধ অনেক সময় শিশুদের শরীরে এলার্জি সৃষ্টি করতে পারে। NSAIDs ব্যবহার করলে ত্বকে র‍্যাশ, হাঁচি, চোখ পানি পড়া এবং কখনো কখনো হঠাৎ শ্বাসকষ্টও দেখা দেয়। বিকল্প হিসেবে প্যারাসিটামল অনেক বেশি নিরাপদ বলে বিবেচিত হয়।

৪. সালফা ভিত্তিক ওষুধ

সালফোনামাইড গ্রুপের ওষুধ যেমন কো-ট্রিমক্সাজল (Co-trimoxazole), সালফাডায়াজিন অনেক শিশুদের জন্য মারাত্মক এলার্জি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। মুখে ঘা, ত্বকে ফোসকা পড়া, জ্বর এসব সাধারণ লক্ষণ। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কখনো এই ধরনের ওষুধ দেওয়া উচিত নয়।

৫. মাল্টিভিটামিন ও ফ্লেভারযুক্ত সিরাপ

অনেক সময় আমরা মনে করি মাল্টিভিটামিন বা হজমের সিরাপ নিরাপদ। কিন্তু এসব সিরাপে থাকা কৃত্রিম রঙ, প্রিজারভেটিভ বা ফ্লেভার অনেক শিশুর এলার্জির কারণ হতে পারে। বিশেষ করে যারা খাবারে এলার্জিতে ভোগে তাদের ক্ষেত্রে এই সিরাপ মারাত্মক হতে পারে।

Related Posts

খাবার এলার্জি কী এবং এটি কেন হয়?

খাবার এলার্জি হলো শরীরের ইমিউন সিস্টেমের অতিপ্রতিক্রিয়া, যা কোনো নির্দিষ্ট খাবার গ্রহণের ফলে ঘটে। শিশুদের ইমিউন সিস্টেম পরিপূর্ণভাবে বিকশিত না হওয়ায় কিছু নির্দিষ্ট প্রোটিন বা উপাদানকে ক্ষতিকর হিসেবে বিবেচনা করে এবং তার ফলে এলার্জি প্রতিক্রিয়া শুরু হয়।

শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ খাবারের তালিকা

১. গরুর দুধ ও ডেইরি পণ্য

গরুর দুধে থাকা প্রোটিন (কেসিন ও হুই) অনেক শিশুর শরীরে এলার্জি সৃষ্টি করতে পারে। এটি সাধারণত ১ বছরের নিচে শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। লক্ষণ হিসেবে দেখা যেতে পারে পেটে গ্যাস, বমি, চুলকানি, র‍্যাশ, অথবা ডায়েরিয়া।

২. ডিম

ডিমের সাদা অংশে থাকা প্রোটিন অনেক শিশুদের জন্য এলার্জির কারণ হতে পারে। এটি শিশুদের ত্বকে ফুসকুড়ি, ঠোঁট ফুলে যাওয়া, অথবা শ্বাসকষ্ট সৃষ্টি করতে পারে।

৩. বাদাম ও চিনাবাদাম

চিনাবাদাম ও গাছ থেকে পাওয়া বাদাম (যেমন: কাঠবাদাম, আখরোট) শিশুদের মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী এলার্জির কারণ। এটি কখনো কখনো তীব্র অ্যানাফাইল্যাক্সিস প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে যা তাৎক্ষণিক চিকিৎসা ছাড়া প্রাণঘাতী হতে পারে।

৪. সি ফুড ও মাছ

চিংড়ি, কাঁকড়া, স্কুইড, এমনকি অনেক ধরনের সামুদ্রিক মাছ এলার্জি সৃষ্টি করতে পারে। শিশুদের শরীরে র‍্যাশ, চোখ লাল হওয়া, অথবা শ্বাস নিতে সমস্যা হতে পারে।

৫. সয়া ও সয়া-প্রোডাক্ট

সয়া প্রোটিন অনেক শিশুর শরীর সহজে গ্রহণ করতে পারে না। এটি শিশুর অন্ত্রে প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং এলার্জির উপসর্গ তৈরি করে।

শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ফলের তালিকা

১. কিউই, স্ট্রবেরি ও আনার

এসব ফলের মধ্যে থাকা প্রাকৃতিক এসিড এবং এনজাইম অনেক শিশুর মুখে জ্বালাপোড়া, চুলকানি বা ত্বকে ফুসকুড়ির কারণ হতে পারে।

২. আনারস

আনারসে থাকা এনজাইম "ব্রোমেলেইন" শিশুদের ত্বকে র‍্যাশ, ঠোঁটে জ্বালাপোড়া বা পাকস্থলীতে গ্যাস সৃষ্টি করতে পারে।

৩. পেঁপে

পেঁপেতে থাকা প্যাপেইন এনজাইম কিছু শিশুদের এলার্জির কারণ হতে পারে। এটি চুলকানি, মুখ ফোলা, অথবা বমি সৃষ্টি করতে পারে।

৪. আম

আমের খোসায় থাকা ইউরুশিয়ল নামক একটি উপাদান অনেক শিশুদের ত্বকে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। অনেক শিশু খোসাসহ আম খেলে ঠোঁট ফোলা বা র‍্যাশের শিকার হয়।

কীভাবে চিহ্নিত করবেন যে শিশুর খাবার এলার্জি রয়েছে?

যখন কোনো খাবার বা ফল খাওয়ার পরপর নিচের উপসর্গ দেখা যায়, তখন বুঝতে হবে শিশুর হয়তো এলার্জি রয়েছে:

  • ত্বকে চুলকানি, লাল দাগ বা র‍্যাশ
  • ঠোঁট, চোখ বা মুখ ফোলা
  • শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া বা কাশি
  • বমি বা ডায়রিয়া
  • মনে অস্থিরতা, কান্না

কি করবেন যদি শিশু এলার্জি প্রতিক্রিয়ায় পড়ে?

এলার্জি প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে দ্রুত নিচের কাজগুলো করুন:

  1. সেই খাবার বা ফল সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করুন।
  2. শিশুকে ঠান্ডা জায়গায় রাখুন ও আরামদায়ক পরিবেশ দিন।
  3. চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে প্রয়োজনীয় অ্যান্টিহিস্টামিন দিন।
  4. গুরুতর অবস্থা হলে নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যান।
  5. শিশুর মেডিকেল ইতিহাসে সেই খাবারটি উল্লেখ করে রাখুন।

শিশুদের এলার্জির লক্ষণসমূহ

আপনার শিশুর যদি নিচের যেকোনো লক্ষণ ওষুধ খাওয়ার পরপর দেখা যায়, তাহলে ধরে নিতে হবে এলার্জি প্রতিক্রিয়া হচ্ছে:

  • ত্বকে র‍্যাশ বা চুলকানি
  • ঠোঁট, চোখ, বা মুখ ফুলে যাওয়া
  • শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া
  • গলা চিপে ধরা অনুভূতি
  • হঠাৎ করে বমি, পেটব্যথা, বা ডায়রিয়া
  • স্নায়বিক সমস্যা – মাথা ঘোরা, দুর্বলতা

এলার্জি হলে করণীয়

এলার্জি প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে দ্রুত নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করুন:

  1. অবিলম্বে ওষুধ দেওয়া বন্ধ করুন।
  2. শিশুকে ফ্রেশ বাতাসে রাখুন এবং হালকা কাপড় পরান।
  3. তৎক্ষণাৎ নিকটস্থ চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যান।
  4. আগে কখনো এমন প্রতিক্রিয়া হলে তার বিস্তারিত লিখে রাখুন।
  5. চিকিৎসককে সব তথ্য জানান – কোন ওষুধ, কখন দেওয়া হয়েছে, কী উপসর্গ দেখা দিয়েছে।

শিশুদের এলার্জির ওষুধের তালিকা

ক্রমিক ওষুধের নাম সক্রিয় উপাদান ডোজ ফর্ম বয়সসীমা ব্যবহার
1 Alatrol Paediatric Drops Cetirizine ড্রপস 6 মাস+ হাঁচি, চোখ চুলকানি, ত্বকের র‍্যাশ
2 Alatrol Syrup Cetirizine সিরাপ 2 বছর+ হাঁচি, চোখ চুলকানি, ত্বকের র‍্যাশ
3 Deslor Kids Desloratadine ড্রপস 6 মাস+ সিজনাল এলার্জি, ত্বকের র‍্যাশ
4 Lora Suspension Loratadine সিরাপ 2 বছর+ সিজনাল এলার্জি, ত্বকের র‍্যাশ
5 Fenadin Suspension Fexofenadine সিরাপ 2 বছর+ হাঁচি, চোখ চুলকানি, ত্বকের র‍্যাশ
6 Antista Syrup Chlorpheniramine Maleate সিরাপ 1 বছর+ হাঁচি, চোখ চুলকানি, ত্বকের র‍্যাশ

গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা:

  1. চিকিৎসকের পরামর্শ: শিশুদের জন্য ওষুধ ব্যবহারের আগে অবশ্যই একজন যোগ্য চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন। ওষুধের ডোজ এবং ব্যবহারের সময়সীমা নির্ধারণে চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুসরণ করুন।
  2. পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: কিছু ওষুধে ঘুম ঘুম ভাব, মাথা ঘোরা, বা পেটের সমস্যা হতে পারে। যদি কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, তাহলে অবিলম্বে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
  3. সংরক্ষণ: ওষুধগুলি শিশুদের নাগালের বাইরে এবং নির্দেশিত তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করুন।

এলার্জি প্রতিরোধে সচেতনতা

শিশুর এলার্জি প্রতিরোধে পরিবার ও অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিচের বিষয়গুলো মেনে চলুন:

  • প্রতিটি ওষুধ দেওয়ার আগে তার উপাদান ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ভালোভাবে যাচাই করুন।
  • চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো নতুন ওষুধ বা সিরাপ দেবেন না।
  • শিশুর চিকিৎসা ইতিহাস লিখে রাখুন এবং স্কুল বা দাদা-দাদির সাথেও শেয়ার করুন।
  • যদি শিশুর এলার্জি মারাত্মক হয়, তাহলে একটি অ্যালার্জি কার্ড ব্যবহার করুন।
  • বিশেষ প্রয়োজনে চিকিৎসকের অনুমোদিত অ্যান্টিহিস্টামিন বা ইনহেলার রাখুন।

উপসংহার

শিশুদের ওষুধ গ্রহণে এলার্জি একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং জরুরি বিষয়। চিকিৎসকের নির্দেশনা ছাড়া কোনো ওষুধ প্রয়োগ না করাই নিরাপদ। অভিভাবকদের উচিত প্রতিটি ওষুধ ব্যবহারের আগে উপাদান ও সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া যাচাই করে নেয়া। শিশুর ভবিষ্যৎ সুস্থতার জন্য সতর্কতা, সচেতনতা এবং সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণই সবচেয়ে বড় সুরক্ষা।

শিশুদের এলার্জি খুব সাধারণ হলেও এটি অনেক সময় গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই অভিভাবকদের উচিত নতুন কোনো খাবার বা ফল শিশুকে দেওয়ার আগে সাবধান হওয়া, পর্যবেক্ষণ করা এবং প্রয়োজনে শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করা। নিরাপদ খাবার নিশ্চিত করা মানেই শিশুর সুস্থ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা।

About the author

Leo
Hey! I'm Leo. I'm always eager to learn new things and enjoy sharing my knowledge with others.

Post a Comment

To avoid SPAM, all comments will be moderated before being displayed.
Don't share any personal or sensitive information.