ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্ট কী: কারণ, সমস্যা ও সমাধান

ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্ট কীভাবে হয়, এর ঝুঁকি, সক্রিয় করার উপায় এবং নিরাপত্তা কৌশল জানুন। এই বিস্তারিত বাংলা গাইডে পেয়ে যান সব তথ্য এক জায়গায়

১. ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্ট কী?

ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্ট হলো এমন একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট যা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোনও আর্থিক কার্যক্রম না হলে নিষ্ক্রিয় বা ডরম্যান্ট হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সাধারণত ১২ মাস থেকে ২৪ মাস পর্যন্ত যদি কোনো লেনদেন না ঘটে, তবে ব্যাংক সেই অ্যাকাউন্টকে নিষ্ক্রিয় হিসেবে চিহ্নিত করে। এই নিষ্ক্রিয়তা কেবলমাত্র আর্থিক লেনদেনের উপর নির্ভরশীল—যেমন টাকা জমা, উত্তোলন, চেক ক্লিয়ার করা, অনলাইন পেমেন্ট ইত্যাদি। ব্যাংকের দৃষ্টিতে, গ্রাহক এই অ্যাকাউন্টটি ব্যবহার করছেন না, ফলে এটি নিরব অর্থের কক্ষ হয়ে দাঁড়ায়।

Dormant

একটি ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্ট সাধারণত খোলা থাকে, কিন্তু এর কিছু কার্যক্রম সীমিত করে দেওয়া হয়। যেমন, অনলাইন ব্যাংকিং, এটিএম কার্ড ব্যবহার, এবং মোবাইল ব্যাংকিং সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। যদিও অ্যাকাউন্টের মধ্যে জমা অর্থ রয়ে যায়, তবুও সেটির ওপর গ্রাহকের নিয়ন্ত্রণ সীমিত হয়ে যায়।

এই অবস্থানটি গ্রাহকের জন্য একটি ঝুঁকি হতে পারে, কারণ অনেক সময় ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্ট থেকে পরিষেবা ফি কেটে নেওয়া হয় কিংবা এটি সরকার বা ব্যাংকের বিশেষ তহবিলে স্থানান্তরিত হয়। সেজন্যই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নিয়মিত ব্যবহারের অভ্যাস রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

২. কখন একটি অ্যাকাউন্ট ডরম্যান্ট হয়ে যায়?

প্রতিটি ব্যাংক তাদের নিজস্ব নীতিমালার ভিত্তিতে একটি অ্যাকাউন্টকে ডরম্যান্ট ঘোষণা করে থাকে। তবে সাধারণভাবে, যদি ১২ মাস থেকে ২৪ মাসের মধ্যে কোনো ধরনের আর্থিক লেনদেন না ঘটে, তবে সেই অ্যাকাউন্টকে ডরম্যান্ট ঘোষণা করা হয়। কিছু ব্যাংকে এই সময়কাল হতে পারে ৬ মাস, আবার কিছু ক্ষেত্রে ৩ বছর পর্যন্তও ধরা হয়।

শুধু অর্থ জমা বা উত্তোলন নয়, নিচের যেকোনো একটি কার্যক্রম না হলে অ্যাকাউন্ট নিষ্ক্রিয় হতে পারে:

  • ATM থেকে টাকা উত্তোলন
  • ইন্টারনেট ব্যাংকিং ব্যবহার
  • মোবাইল অ্যাপ দিয়ে অর্থ স্থানান্তর
  • চেকের মাধ্যমে লেনদেন
  • ক্রেডিট কার্ড বিল পরিশোধ

যদি অ্যাকাউন্টটি যৌথ (Joint Account) হয় এবং কোনো একজন অ্যাকাউন্টধারী লেনদেন করলেও সেটি সক্রিয় হিসেবে বিবেচিত হয়। ব্যাংক ডরম্যান্ট হওয়ার আগে গ্রাহককে সাধারণত ইমেল বা SMS এর মাধ্যমে অবগত করে থাকে। কিন্তু অনেক গ্রাহক সেটি লক্ষ্য না করায় পরবর্তীতে অ্যাকাউন্ট ব্যবহারে সমস্যায় পড়েন।

৩. ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্টের ফলে কী কী সমস্যা হতে পারে?

একটি অ্যাকাউন্ট ডরম্যান্ট হলে গ্রাহকের জন্য নানা ধরনের অসুবিধা তৈরি হতে পারে। প্রথমত, অ্যাকাউন্টে থাকা অর্থের উপর সহজ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায়। গ্রাহক ইচ্ছেমতো টাকা তুলতে বা স্থানান্তর করতে পারেন না। দ্বিতীয়ত, এটিএম ও অনলাইন ব্যাংকিং অ্যাক্সেস বন্ধ হয়ে যায়, ফলে ডিজিটাল ব্যাংকিং সম্পূর্ণভাবে অকার্যকর হয়ে পড়ে।

তৃতীয়ত, কিছু ব্যাংক ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্টের ওপর বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণ ফি আরোপ করে, যা সময়ের সাথে সাথে অ্যাকাউন্টের ব্যালান্স কমিয়ে ফেলে। নিচে কিছু সাধারণ সমস্যা তুলে ধরা হলো:

  • ফান্ড ফ্রিজ: অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা উত্তোলন নিষিদ্ধ হয়ে পড়ে।
  • অ্যাক্সেস রেস্ট্রিকশন: অনলাইন পোর্টাল, অ্যাপ, বা মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আসে।
  • ফি ও চার্জ: কিছু ব্যাংকে ফি আরোপ করা হয়, যা বিনা ব্যবহারেই অ্যাকাউন্ট থেকে কেটে নেওয়া হয়।
  • তহবিল স্থানান্তর: সরকার নির্ধারিত সময় পর অর্থটি একটি বিশেষ তহবিলে স্থানান্তর হতে পারে।

এইসব কারণে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নিয়মিত লেনদেন না করলেও সময়ে সময়ে অন্তত একটি ছোট লেনদেন করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

৪. ব্যাংকের নীতিমালা: ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্ট পরিচালনা

ব্যাংকগুলো তাদের নিজস্ব নীতিমালার মাধ্যমে ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্ট চিহ্নিত ও পরিচালনা করে থাকে। এই নীতিগুলো সাধারণত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী তৈরি করা হয়। ব্যাংক সাধারণত একটি নির্দিষ্ট সময় পর অ্যাকাউন্টের কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে, এবং যদি কোনো লেনদেন না দেখা যায়, তখন সেটি ‘ইনঅ্যাক্টিভ’ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং আরও সময় পর সেটিকে ‘ডরম্যান্ট’ ঘোষণা করে।

নিচে ব্যাংকের কিছু সাধারণ নীতিমালা তুলে ধরা হলো:

  • ১২ মাস কোনো কার্যক্রম না হলে অ্যাকাউন্ট ইনঅ্যাক্টিভ হয়
  • ২৪ মাস পর সেটি ডরম্যান্ট হিসেবে ঘোষিত হয়
  • ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্টে সীমিত পরিষেবা দেওয়া হয়
  • ব্যাংক গ্রাহককে নোটিশ/ইমেল পাঠানোর চেষ্টা করে
  • বিশেষ ফর্ম পূরণ ও KYC আপডেট করলে অ্যাকাউন্ট সক্রিয় হয়

অনেক ব্যাংক গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টাও করে, যেমন ফোন কল, ইমেইল, বা SMS এর মাধ্যমে। তবে গ্রাহক সাড়া না দিলে অ্যাকাউন্টের কার্যক্রম সীমিত করে দেওয়া হয় এবং অ্যাকাউন্ট রক্ষার্থে ফি কেটে নেওয়া হয়।

৫. ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্টে কীভাবে প্রভাব পড়ে গ্রাহকের ওপর?

একটি নিষ্ক্রিয় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট কেবলমাত্র আর্থিকভাবে নয়, মানসিকভাবেও গ্রাহকের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। যখন আপনি হঠাৎ করে টাকা তুলতে গিয়ে দেখলেন অ্যাকাউন্ট ডরম্যান্ট, তখন হতাশা ও বিভ্রান্তি তৈরি হয়। ব্যবসায়িক বা জরুরি অবস্থায় এমন পরিস্থিতি একটি বড় সংকটের কারণ হতে পারে।

অনেক ক্ষেত্রে, গ্রাহক তার অ্যাকাউন্ট ডরম্যান্ট হয়ে গেছে তা জানেন না। একমাত্র যখন টাকা তুলতে যান বা কোনো পেমেন্ট করতে চান তখন বিষয়টি ধরা পড়ে। আবার কিছু ব্যাংক আপনার পরিচয় যাচাই (KYC) আবারও চায়, যা সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া হতে পারে। সেজন্য সচেতনতা থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সামগ্রিকভাবে, একটি ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্ট একটি স্লিপিং টাইগারের মতো—আপনার অর্থ সেখানে আছে ঠিকই, কিন্তু আপনি সেটার ওপর কোনো কার্যকর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন না যতক্ষণ না আপনি নিজে উদ্যোগ নিয়ে অ্যাকাউন্ট পুনরায় সচল করেন।

৬. ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্ট কীভাবে পুনরায় সক্রিয় করবেন?

ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্ট পুনরায় সক্রিয় করতে হলে আপনাকে সাধারণত আপনার ব্যাংকে যেতে হবে এবং একটি নির্দিষ্ট ফর্ম পূরণ করতে হবে। অধিকাংশ ব্যাংকে “KYC” (Know Your Customer) ডকুমেন্ট আপডেট করাও বাধ্যতামূলক। কিছু ব্যাংক অনলাইন বা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমেও প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার সুযোগ দেয়।

নিচে ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্ট সক্রিয় করার ধাপগুলো তুলে ধরা হলো:

  1. নিকটস্থ শাখায় যোগাযোগ করুন
  2. জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্ট প্রদান করুন
  3. একটি স্বাক্ষরযুক্ত ফর্ম পূরণ করুন
  4. KYC তথ্য হালনাগাদ করুন
  5. ছোট একটি আর্থিক লেনদেন করুন (যেমন টাকা জমা)

কিছু ব্যাংক অনলাইন KYC আপডেটের সুবিধা প্রদান করে, যেখানে আপনি মোবাইল নম্বর যাচাই, ফটো আপলোড এবং ভিডিও কলের মাধ্যমে পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেন। প্রক্রিয়াটি সাধারণত ২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সম্পন্ন হয়।

৭. অনলাইন ব্যাংকিং এবং ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্ট

আপনি যদি অনলাইন ব্যাংকিং ব্যবহার করতে অভ্যস্ত হন, তাহলে ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্ট হওয়া আপনার জন্য বিরাট সমস্যা তৈরি করতে পারে। একবার অ্যাকাউন্ট ডরম্যান্ট হলে আপনার ইউজার আইডি নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে, এবং লগইন করলেই ‘অ্যাকাউন্ট ইজ ইনঅ্যাক্টিভ’ ধরনের বার্তা দেখা যাবে।

এই অবস্থায়, আপনি লগইন করতে পারবেন না, অর্থ স্থানান্তর করতে পারবেন না, এমনকি আপনার অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স পর্যন্ত দেখতে পারবেন না। ব্যাংক সাধারণত অনলাইন ব্যাংকিং অ্যাক্সেস ফেরত দিতে গ্রাহকের KYC আপডেট এবং একবার লেনদেন করার প্রমাণ চায়।

অনলাইন ব্যাংকিং চালু রাখতে চাইলে প্রতি ৬ মাসে অন্তত একটি ছোট লেনদেন করুন। এটি হতে পারে একটি বিল পেমেন্ট, টাকা স্থানান্তর বা অ্যাকাউন্টে কিছু অর্থ জমা। এই ছোট ছোট কার্যক্রমগুলো আপনাকে ডরম্যান্ট অবস্থা থেকে দূরে রাখবে।

৮. ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্টে জমা অর্থের নিরাপত্তা

অনেকেই ভাবেন, ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্টের টাকা হারিয়ে যেতে পারে। বাস্তবে, ব্যাংক আপনাকে আগেই জানিয়ে দেয় যে অ্যাকাউন্ট নিষ্ক্রিয় হতে চলেছে এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকে। তবে দীর্ঘ সময় কোন যোগাযোগ না থাকলে কিছু দেশের নীতিমালায় সেই অর্থ সরকার নির্ধারিত তহবিলে স্থানান্তরিত হতে পারে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী যদি কোনো অ্যাকাউন্ট ১০ বছর পর্যন্ত ডরম্যান্ট থাকে এবং গ্রাহকের কোনো খোঁজ না পাওয়া যায়, তাহলে সেই অর্থ “Depositor Education and Awareness Fund” (DEAF) নামক তহবিলে স্থানান্তর করা হয়। গ্রাহক পরে উপযুক্ত প্রমাণ উপস্থাপন করে অর্থ ফেরত নিতে পারেন।

তাই নিরাপদে অর্থ রাখার পাশাপাশি নিয়মিত অ্যাকাউন্টের খবর নেওয়া জরুরি। একটি ছোট অ্যাক্টিভিটি আপনার সঞ্চয়কে নিরাপদ রাখতে পারে অনেক বছর পর্যন্ত।

৯. যৌথ অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রে ডরম্যান্ট হওয়া

যৌথ অ্যাকাউন্ট (Joint Account) এর ক্ষেত্রে নিয়ম কিছুটা আলাদা হতে পারে। যদি দুটি বা ততোধিক ব্যক্তি মিলে একটি অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করেন এবং তাদের মধ্যে অন্তত একজন নিয়মিত লেনদেন করেন, তবে সেটি ডরম্যান্ট হয় না।

তবে, যদি সকল অংশীদার একসাথে দীর্ঘদিন অ্যাকাউন্ট ব্যবহার না করেন, তাহলে সেটি ডরম্যান্ট হিসেবে গণ্য হতে পারে। আবার যদি একজন মৃত্যু বরণ করেন এবং অন্য অংশীদার অ্যাকাউন্ট সক্রিয় না করেন, তবে সেটিও নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট (মৃত্যু সনদ, উত্তরাধিকার সনদ ইত্যাদি) জমা দিতে হয়।

যৌথ অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রে নিয়মিত ব্যালান্স চেক করা, অংশীদারদের মধ্যে যোগাযোগ বজায় রাখা এবং কমপক্ষে বছরে একবার লেনদেন করার অভ্যাস গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি।

১০. ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্ট বন্ধ করার প্রক্রিয়া

যদি আপনি মনে করেন যে একটি অ্যাকাউন্ট আর আপনার প্রয়োজন নেই, তবে সেটি ডরম্যান্ট হওয়ার আগেই বন্ধ করে দেওয়া ভালো। একটি নিষ্ক্রিয় অ্যাকাউন্ট বন্ধ করতে হলে আপনাকে আগে সেটি সক্রিয় করতে হবে। অর্থাৎ, প্রথমে একটি ছোট লেনদেন করে অ্যাকাউন্ট পুনরায় চালু করতে হবে, তারপর বন্ধের জন্য আবেদন করতে হবে।

নিচে অ্যাকাউন্ট বন্ধ করার ধাপগুলো তুলে ধরা হলো:

  1. ব্যাংকে গিয়ে অ্যাকাউন্ট সক্রিয় করুন
  2. আবশ্যকীয় কাগজপত্র জমা দিন (জাতীয় পরিচয়পত্র, চেকবই ইত্যাদি)
  3. ‘Account Closure Form’ পূরণ করুন
  4. আপনার সব ব্যালান্স তুলে নিন বা স্থানান্তর করুন
  5. ব্যাংকের ফাইনাল প্রসেসিং এর জন্য অপেক্ষা করুন

অনেক গ্রাহক ভুল করে ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্ট বন্ধ না করেই রেখে দেন, যা পরবর্তীতে ফি আরোপ বা আর্থিক ঝামেলার কারণ হতে পারে। তাই এটি একটি ভালো অভ্যাস যে আপনি ব্যবহৃত না হওয়া অ্যাকাউন্ট যথাসময়ে বন্ধ করে দেন।

অন্যান্য পোস্টগুলো পড়ুন

১১. শিশু ও প্রবীণদের অ্যাকাউন্টে ডরম্যান্ট হওয়ার সম্ভাবনা

শিশু ও প্রবীণদের নামে খোলা অ্যাকাউন্ট সাধারণত কম ব্যবহৃত হয়। এই ধরনের অ্যাকাউন্ট অনেক সময় শুধুমাত্র সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যে খোলা হয় এবং দীর্ঘ সময় ব্যবহৃত না হওয়ায় ডরম্যান্ট হয়ে পড়ে। শিশুদের অ্যাকাউন্ট বাবা-মা বা অভিভাবক পরিচালনা করেন, তবে তারা নিয়মিত তদারকি না করলে অ্যাকাউন্ট নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারে।

প্রবীণ নাগরিকরা অনেকে ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের সাথে খুব একটা পরিচিত নন। ফলে তারা ব্যাংকে গিয়ে লেনদেন করতে পছন্দ করেন। তবে স্বাস্থ্যগত কারণে ব্যাংকে যাওয়া সম্ভব না হলে অ্যাকাউন্টে কোনো লেনদেন না ঘটায় সেগুলো ধীরে ধীরে ডরম্যান্ট হয়ে পড়ে।

এ ধরনের অ্যাকাউন্ট সচল রাখতে অভিভাবক বা আত্মীয়দের উচিত বছরে অন্তত একবার লেনদেন করা বা একটি স্বল্প পরিমাণ অর্থ জমা রাখা। কিছু ব্যাংকে প্রবীণদের জন্য আলাদা ডরম্যান্ট নীতিমালা রয়েছে, যেখানে বিশেষ ছাড় বা সময় দেওয়া হয়।

১২. আন্তর্জাতিক রেমিট্যান্স ও ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্ট

যেসব অ্যাকাউন্ট আন্তর্জাতিক রেমিট্যান্স পাওয়ার জন্য খোলা হয়েছে কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে কোনো টাকা পাঠানো হচ্ছে না, সেগুলোও ডরম্যান্ট হয়ে যেতে পারে। অনেক প্রবাসী নিজ দেশের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠান না কারণ তারা বিদেশে নতুন ব্যাংক ব্যবহার করেন, ফলে পুরনো অ্যাকাউন্ট ব্যবহৃত হয় না।

এই অ্যাকাউন্টগুলো সক্রিয় রাখতে হলে বছরে অন্তত একবার বিদেশ থেকে একটি ছোট রেমিট্যান্স পাঠানো যেতে পারে অথবা পরিবারের কেউ দেশে থেকে একটি ছোট লেনদেন করতে পারেন। অনেক ব্যাংক বিশেষ সুবিধা দেয় যেমন—নিম্ন সার্ভিস চার্জ, অতিরিক্ত সময়, অথবা KYC আপডেটের জন্য সহজ প্রক্রিয়া।

রেমিট্যান্স অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে গেলে পুনরায় চালু করতে ব্যাংকে কাগজপত্র জমা দিতে হয় এবং প্রবাসী গ্রাহকের জন্য এটি অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ এবং জটিল হতে পারে। তাই এই অ্যাকাউন্টের কার্যক্রম সচল রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

১৩. ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্ট এবং ব্যাংকিং ফ্রড

ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্টগুলো সাইবার অপরাধীদের জন্য একটি সহজ টার্গেট হতে পারে। কারণ এসব অ্যাকাউন্টে গ্রাহক নিয়মিত নজর রাখেন না, ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত লেনদেন বা হ্যাকিং সহজে ধরা পড়ে না। অনেক সময় হ্যাকাররা এই অ্যাকাউন্টগুলো হাইজ্যাক করে নতুন KYC ডকুমেন্ট দাখিল করে অর্থ উত্তোলনের চেষ্টা করে।

ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্ট রক্ষা করতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া দরকার:

  • নিয়মিত অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স চেক করা
  • ব্যাংকের সাথে মোবাইল নম্বর হালনাগাদ রাখা
  • SMS ও ইমেইল অ্যালার্ট চালু রাখা
  • অনলাইন ব্যাংকিংয়ের পাসওয়ার্ড প্রায় সময় পরিবর্তন করা
  • ফিশিং বা স্ক্যাম মেসেজ এড়ানো

একটি নিরাপদ ব্যাংকিং অভিজ্ঞতার জন্য, সচেতনতা ও নিয়মিত নজরদারি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আপনার অ্যাকাউন্ট আপনি না দেখলে, কে দেখবে?

১৪. ব্যাংকের পক্ষ থেকে যোগাযোগের প্রচেষ্টা

ব্যাংক সাধারণত একটি অ্যাকাউন্ট ডরম্যান্ট হওয়ার আগে গ্রাহকের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করে। তারা ইমেইল, SMS, ফোন কলের মাধ্যমে অবগত করার চেষ্টা করে যাতে গ্রাহক অন্তত একটি লেনদেন করেন বা ব্যাংকে এসে KYC হালনাগাদ করেন।

অনেক সময় দেখা যায়, গ্রাহকের মোবাইল নম্বর বা ইমেইল ঠিকানা আপডেট করা না থাকায় ব্যাংকের এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ফলে গ্রাহক জানতেও পারেন না যে তার অ্যাকাউন্ট নিষ্ক্রিয় হতে চলেছে।

তাই, আপনি যখনই ব্যাংক পরিবর্তন করেন বা আপনার মোবাইল নম্বর পরিবর্তন করেন, তখন ব্যাংককে অবগত করা খুব জরুরি। একটি আপডেটেড যোগাযোগ মাধ্যম আপনাকে ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ বার্তা সময়মতো পেতে সাহায্য করবে।

১৫. ভবিষ্যতের জন্য করণীয়

আপনার অর্থের সুরক্ষা এবং ব্যাংকিং পরিষেবার সুবিধা অব্যাহত রাখতে হলে আপনাকে কিছু অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। অ্যাকাউন্ট যদি নিয়মিত ব্যবহারের প্রয়োজন না হয়, তাহলেও প্রতি ৬ মাসে অন্তত একটি ছোট লেনদেন করুন। এটিই আপনাকে ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্টের ঝুঁকি থেকে রক্ষা করবে।

নিচে ভবিষ্যতের জন্য কিছু করণীয় দেয়া হলো:

  • প্রতি ছয় মাসে অ্যাকাউন্টে অন্তত একটি লেনদেন করুন
  • আপনার মোবাইল নম্বর ও ইমেইল ঠিকানা আপডেট রাখুন
  • SMS ও ইমেইল নোটিফিকেশন চালু রাখুন
  • ব্যাংক অ্যাপ ব্যবহার শিখে নিন
  • ব্যাংকে KYC আপডেট করার সময়সীমা মনে রাখুন

একটি সচল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট কেবলমাত্র আর্থিক লেনদেনের উপায় নয়, এটি আপনার পরিচয়, আপনার সঞ্চয় এবং ভবিষ্যতের নিরাপত্তা। আপনি যদি সচেতন থাকেন, তাহলে ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্ট আপনাকে আর চমকে দিতে পারবে না।

উপসংহার

ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্টকে অনেকেই অবহেলা করেন, কিন্তু এটি আর্থিকভাবে গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। আপনি যদি নিয়মিত আপনার অ্যাকাউন্টের তদারকি না করেন, তাহলে শুধু ফিচার হারানো নয় বরং আপনার সঞ্চয়ের ওপরও ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। এটি কেবলমাত্র একটি নিষ্ক্রিয় অ্যাকাউন্ট নয়, বরং একটি সতর্কবার্তা—আপনার অর্থিক জীবনকে আরও সচেতনভাবে পরিচালনা করার।

প্রতিটি ব্যাংক তাদের নিজস্ব নীতিমালা অনুযায়ী ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করে, তাই সময়মতো অ্যাকাউন্ট চালু রাখা, KYC আপডেট করা এবং যোগাযোগের মাধ্যম সচল রাখা জরুরি। আজই আপনার অ্যাকাউন্ট চেক করুন—আপনার টাকা এবং সুরক্ষা আপনার হাতে।

মনে রাখবেন, একটি ছোট পদক্ষেপ যেমন একটি মোবাইল রিচার্জ বা বিল পেমেন্টই আপনার অ্যাকাউন্টকে ডরম্যান্ট হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারে। সচেতন হোন, সুরক্ষিত থাকুন!

FAQs: প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলি

১. ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্ট কতদিন পর হয়?

উত্তর: বাংলাদেশে কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টানা ১২ মাস কোনো লেনদেন না হলে তা ইনঅ্যাক্টিভ এবং ২৪ মাস পর ডরম্যান্ট বলে গণ্য হয়।

২. ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্টে টাকা কি হারিয়ে যায়?

উত্তর: না, টাকা হারায় না। তবে দীর্ঘদিন ব্যবহৃত না হলে অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দিষ্ট তহবিলে স্থানান্তরিত হতে পারে, যেখান থেকে আপনি ফেরত পেতে পারেন নির্ধারিত প্রক্রিয়ায়।

৩. আমি কিভাবে জানতে পারবো আমার অ্যাকাউন্ট ডরম্যান্ট হয়েছে কি না?

উত্তর: আপনি অনলাইন ব্যাংকিংয়ে লগইন করতে না পারলে বা ATM ব্যবহার করতে না পারলে এবং ব্যাংক থেকে SMS বা ইমেইল পেয়ে থাকলে সেটি ডরম্যান্টের লক্ষণ হতে পারে।

৪. ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্ট কি অনলাইনেই সক্রিয় করা যায়?

উত্তর: কিছু ব্যাংক অনলাইন বা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে KYC আপডেট ও লেনদেনের মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট পুনরায় চালুর সুবিধা দেয়, তবে অনেক ক্ষেত্রে শাখায় যেতে হয়।

৫. ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্ট বন্ধ করতে কি করতে হবে?

উত্তর: প্রথমে একটি ছোট লেনদেনের মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট সক্রিয় করতে হবে, তারপর ব্যাংকে গিয়ে নির্ধারিত ফর্ম পূরণ করে অ্যাকাউন্ট বন্ধ করা যাবে।

About the author

Leo
Hey! I'm Leo. I'm always eager to learn new things and enjoy sharing my knowledge with others.

Post a Comment

To avoid SPAM, all comments will be moderated before being displayed.
Don't share any personal or sensitive information.