সর্বনিম্ন কত টাকা থাকলে কুরবানী দিতে হবে? | কুরবানীর ইসলামী বিধান ও নিসাব হিসাব

কুরবানী দিতে হলে সর্বনিম্ন কত টাকা থাকতে হবে? ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে নিসাবের পরিমাণ, কাদের ওপর কুরবানী ওয়াজিব, নারীদের জন্য বিধানসহ বিস্তারিত জানুন

কুরবানী কী এবং কেন করা হয়?

ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে কুরবানীর গুরুত্ব

কুরবানী শব্দটির অর্থ হলো নৈকট্য লাভ করা। ইসলাম ধর্মে কুরবানী একটি মহান ইবাদত, যা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সম্পাদিত হয়। এটি শুধু পশু জবাই নয়, বরং এক গভীর আত্মত্যাগ এবং আনুগত্যের প্রতীক। পবিত্র কুরআনের সূরা কাউসারে বলা হয়েছে, “তোমার প্রভুর উদ্দেশ্যে নামাজ পড় এবং কুরবানী করো।” এই আয়াত থেকে স্পষ্ট যে, নামাজের পরেই কুরবানীর স্থান। হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজ হাতে কুরবানী করতেন এবং মুসলিম উম্মাহকে এই ইবাদতে অংশগ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন।

এই ইবাদতের মাধ্যমে আমরা শেখি কিভাবে নিজের চাহিদা, ভালোবাসা ও স্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে আল্লাহর আদেশকে প্রাধান্য দিতে হয়। এটি মূলত আত্মসংযম, দানশীলতা এবং সাম্যবোধের প্রতীক। কুরবানীর মাধ্যমে গরীব-দুঃখীদের সাথে খাবার ভাগাভাগি করার সুযোগ হয়, যার ফলে সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় হয়।

korbani

কুরবানীর ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট

কুরবানীর ইতিহাস হযরত ইব্রাহিম (আ.) এবং তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ.) এর আত্মত্যাগের ঘটনা দিয়ে সূচিত। যখন ইব্রাহিম (আ.) স্বপ্নে দেখলেন যে, তিনি তাঁর সন্তানকে আল্লাহর পথে কুরবানী করছেন, তখন বিনা দ্বিধায় সেই আদেশ পালন করতে প্রস্তুত হন। ইসমাইল (আ.)-ও স্বেচ্ছায় রাজি হয়ে যান। আল্লাহ এই উত্তীর্ণ পরীক্ষায় তাঁদের সার্থকতা প্রদান করে একটি দুম্বা কুরবানী করার নির্দেশ দেন। এই ঐতিহাসিক ঘটনার স্মরণে প্রতি বছর জিলহজ মাসের ১০ তারিখ মুসলিমরা কুরবানী করেন।

এই ঘটনা কেবল ইতিহাস নয়, এটি আমাদের শিক্ষা দেয়, কিভাবে নিজের সর্বোচ্চ প্রিয় জিনিস আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করতে হয়।

কাদের উপর কুরবানী ফরজ বা ওয়াজিব?

শরীয়ত অনুযায়ী শর্তাবলি

ইসলামে কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার জন্য কিছু নির্দিষ্ট শর্ত রয়েছে। এগুলো পূরণ না হলে কুরবানী করা ফরজ বা ওয়াজিব হয় না। যেসব শর্তগুলি অনুসরণযোগ্য তা হলো:

  • মুসলমান হওয়া
  • বালেগ (প্রাপ্তবয়স্ক) হওয়া
  • আক্ল বা বিবেকসম্পন্ন হওয়া
  • নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া
  • মুকীম (মুসাফির না হওয়া)

যে ব্যক্তি উপরোক্ত শর্তগুলি পূরণ করেন, তাঁর উপর কুরবানী ওয়াজিব হয়ে যায়। তবে এক্ষেত্রে জোর করে কাউকে কুরবানী করানো অনুচিত। এটি হতে হবে নিজে থেকে এবং আন্তরিকভাবে।

নারী ও পুরুষের জন্য বিধান

কুরবানী শুধুমাত্র পুরুষের জন্য নয়, নারীর ওপরও ওয়াজিব হতে পারে। যদি কোনো নারীর নিজ নামে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে এবং তিনি উল্লিখিত শর্তগুলো পূরণ করেন, তাহলে তাঁর ওপর কুরবানী ওয়াজিব হবে। অনেকেই মনে করেন শুধুমাত্র পুরুষরাই কুরবানী দিতে পারেন, কিন্তু ইসলামে নারীদের জন্যও এ বিধান রয়েছে।

নারীরা যদি স্বর্ণ, রূপা বা টাকার মাধ্যমে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হন, তাহলে তাদের জন্য কুরবানী দেওয়া আবশ্যক। বিশেষ করে বিবাহিত নারীদের মধ্যে অনেকেই দামী গহনার মালিক, যেটি নিসাব অতিক্রম করে। সেক্ষেত্রে আলাদা হিসাব করে দেখা দরকার—তাঁর ওপর কুরবানী ওয়াজিব কি না।

সর্বনিম্ন কত টাকা থাকলে কুরবানী ওয়াজিব হয়?

নিসাবের মানদণ্ড

নিসাব অর্থ হলো নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ, যার মালিক হলে কুরবানী ওয়াজিব হয়। হাদীস অনুযায়ী, নিসাবের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে ৭.৫ তোলা স্বর্ণ বা ৫২.৫ তোলা রূপা। কেউ যদি এই পরিমাণ সম্পদের মালিক হন, এবং প্রয়োজনীয় খরচ বাদে সেই সম্পদ তার কাছে থাকে, তাহলে তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব।

নিসাব শুধু স্বর্ণ বা রূপা নয়—টাকায় হিসাব করা সম্ভব। অনেক আলেম বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে রূপার মূল্যে নিসাব নির্ধারণে উৎসাহ দেন, কারণ এটা অপেক্ষাকৃত কম এবং অধিকাংশ মুসলিম যাতে এ ইবাদতে অংশগ্রহণ করতে পারে, সেটি নিশ্চিত করে।

বর্তমান বাজার মূল্যে নিসাবের হিসাব

২০২৫ সালের প্রেক্ষাপটে যদি রূপার দাম প্রতি তোলা ১২০ টাকা হয়, তাহলে ৫২.৫ তোলা × ১২০ = ৬,৩০০ টাকা হয়। অর্থাৎ, কারো কাছে ৬,৩০০ টাকা বা তার সমমূল্যের সম্পদ থাকলে (যা তার প্রয়োজনীয় খরচ ও ঋণের বাইরে), তাহলে তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব হবে।

অন্যদিকে, স্বর্ণের হিসাব করলে প্রতি তোলা ৯,০০০ টাকা ধরলে নিসাব হয় ৭.৫ × ৯০০০ = ৬৭,৫০০ টাকা। এই দুটির মধ্যে যেকোনো একটিতে নিসাব পরিমাণ হলে কুরবানী ওয়াজিব হয়ে যায়। তবে অধিকাংশ ফিকহ মত অনুযায়ী, রূপার নিসাব বেশি গ্রহণযোগ্য।

নিসাব কী এবং তা কিভাবে নির্ধারিত হয়?

স্বর্ণ ও রূপার উপর ভিত্তি করে নিসাব

নিসাব নির্ধারণের জন্য মূলত দুটি মাধ্যম ব্যবহৃত হয়—স্বর্ণ ও রূপা। এটি কেবল কুরবানীর জন্য নয়, যাকাতের ক্ষেত্রেও এই হিসাব ব্যবহৃত হয়। স্বর্ণের ক্ষেত্রে ৭.৫ তোলা এবং রূপার ক্ষেত্রে ৫২.৫ তোলা নির্ধারিত আছে। একজন ব্যক্তি যদি এর মালিক হন, তবে তাঁর ওপর কুরবানী ওয়াজিব হয়।

অনেক সময় লোকজন কনফিউশনে পড়ে যান যে কোনটা ভিত্তি হিসেবে নিতে হবে। মূলতঃ দরিদ্র মানুষের জন্য সুবিধাজনক হয় যাতে তারা ইবাদত থেকে বঞ্চিত না হয়—সেজন্য রূপার নিসাব বেশি উপযোগী ধরা হয়।

ব্যক্তিগত ব্যয় ও ঋণ বাদ দিয়ে হিসাব

নিসাব নির্ধারণ করতে গিয়ে মনে রাখতে হবে, ব্যক্তির প্রয়োজনীয় খরচ, বাসস্থান, চিকিৎসা, খাবার, এবং শিক্ষার মতো খরচ বাদ দিতে হবে। একইসাথে, তার যদি ঋণ থাকে, তাহলে সেটাও বাদ দিতে হবে। অবশিষ্ট অর্থ যদি নিসাব অতিক্রম করে, তবেই কুরবানী ওয়াজিব হবে।

অনেকে মনে করেন যেহেতু ব্যাংকে টাকা আছে, তাই কুরবানী দিতে হবে। কিন্তু যদি সেই টাকা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করতে হয়, তাহলে সেটা হিসাবের বাইরে থাকবে। তাই নিসাব নির্ধারণ করতে হলে অবশ্যই খোলামেলা ও সঠিকভাবে আর্থিক অবস্থা পর্যালোচনা করতে হবে।

2025 সালে কুরবানীর জন্য সর্বনিম্ন নিসাব কত?

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী হিসাব

২০২৫ সালের জন্য কুরবানীর নিসাব নির্ধারণ করতে হলে আমাদের আগে জানতে হবে স্বর্ণ ও রূপার বর্তমান বাজারমূল্য। এই মূল্য সাধারণত বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকিতে বাজারে ওঠানামা করে থাকে। ধরুন রূপার বাজার মূল্য প্রতি ভরি ১২০ টাকা এবং স্বর্ণের মূল্য প্রতি ভরি ৯,৫০০ টাকা। তাহলে রূপার ভিত্তিতে নিসাব হবে ৫২.৫ × ১২০ = ৬,৩০০ টাকা এবং স্বর্ণের ভিত্তিতে নিসাব হবে ৭.৫ × ৯,৫০০ = ৭১,২৫০ টাকা।

অনেক ইসলামী স্কলার রূপার নিসাব অনুসরণ করাকে অধিকতর সহানুভূতিশীল ও প্রাসঙ্গিক মনে করেন। কেননা এটি অপেক্ষাকৃত কম মূল্যের হওয়ায় গরীব বা মধ্যবিত্ত মুসলিমদের ইবাদতে অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়ে। তবে স্বর্ণের নিসাবকে কেউ অস্বীকার করছে না; বরং নির্ভর করছে ব্যক্তির আর্থিক অবস্থা, নির্দিষ্ট সম্পদের ধরণ, এবং খরচ বাদ দিয়ে নিট সম্পদের পরিমাণের ওপর।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যে যারা মাস শেষে কিছু টাকা সঞ্চয় করতে পারেন, তারা সহজেই এই নিসাবের পরিমাণ ছুঁয়ে ফেলতে পারেন। কাজেই কুরবানীর সময় সেই সঞ্চয় যদি নিসাব অতিক্রম করে, তাহলে কুরবানী দেওয়া ওয়াজিব হয়ে যায়।

প্রায়োগিক উদাহরণ

চলুন একটি বাস্তব উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করি। ধরুন, একজন ব্যক্তি ব্যাংকে ১০,০০০ টাকা জমা রেখেছেন। তার কোনো ঋণ নেই এবং তার দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় খরচের বাইরে এই টাকা তার কাছে একটানা আছে। তাহলে তিনি নিসাব পরিমাণ অর্থের মালিক। রূপার দামে হিসাব করলে নিসাব ছিল মাত্র ৬,৩০০ টাকা। সুতরাং, এই ব্যক্তির উপর কুরবানী দেওয়া ওয়াজিব হবে।

আরেকটি উদাহরণ: একজন গৃহিণী যিনি ১৫,০০০ টাকার গহনার মালিক এবং তার বাড়তি কোনো খরচ বা ঋণ নেই। সেক্ষেত্রে, তিনিও নিসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারী। যদিও তিনি নিজে উপার্জন করেন না, তবুও তিনি নিজস্ব সম্পদের ভিত্তিতে কুরবানীর আওতাভুক্ত হবেন।

এইসব উদাহরণ থেকে বোঝা যায়, নিসাব কেবল আয় বা মাসিক বেতন নয়, বরং নিট সম্পদের হিসাব—যেটি প্রয়োজনীয় খরচ বাদ দিয়ে আপনার হাতে থাকে।

কুরবানীর জন্য সম্পদের ধরন

কোন সম্পদ গণনায় ধরা হয়?

কুরবানীর জন্য নিসাব নির্ধারণে সম্পদের ধরন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সকল সম্পদ এ হিসাবের আওতায় পড়ে না। শুধু সেইসব সম্পদ নিসাব নির্ধারণে ধরা হবে যেগুলো “বাড়তি” অর্থাৎ প্রয়োজনের অতিরিক্ত এবং স্থায়ী নয়। উদাহরণস্বরূপ:

  • নগদ অর্থ (ব্যাংক একাউন্ট বা হাতের টাকা)
  • সোনা ও রূপার গহনা
  • বিনিয়োগ করা অর্থ
  • পণ্য বা সামগ্রী যা বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে রাখা হয়েছে

তবে নিচের জিনিসগুলো এই হিসাবের বাইরে থাকবে:

  • ব্যবহারের গাড়ি
  • নিজের বাড়ি
  • প্রয়োজনীয় আসবাব
  • ব্যবসার উপকরণ যা বিক্রির জন্য নয়

এই হিসেবে স্বচ্ছতা থাকা জরুরি। অনেকেই ভুল করে প্রয়োজনীয় ব্যবহারিক জিনিসের মূল্য নিসাব হিসেবে ধরেন, যা ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক নয়।

Related Posts

সম্পদের স্থায়িত্ব ও হিসাবের সময়কাল

কুরবানীর জন্য নিসাবপূর্ণ সম্পদ কুরবানীর তিন দিনের মধ্যে যে কোনো একদিনে ব্যক্তির মালিকানায় থাকলেই যথেষ্ট। যাকাতের মতো এক বছর সম্পদ রাখার প্রয়োজন নেই। উদাহরণত, কেউ যদি ঈদের ঠিক আগের দিন নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হন, তবে তার জন্যও কুরবানী ওয়াজিব হয়ে যায়।

এছাড়াও, কিছু আলেম বলেন কুরবানীর আগে যদি সম্পদ নিসাব অতিক্রম করে এবং ব্যক্তির মনে থাকে কুরবানী করার ইচ্ছা, তাহলে সেটা ইবাদতের মানসিক প্রস্তুতির অংশ হিসেবে গণ্য হয়। সুতরাং সময় এবং স্থায়িত্ব—দুই দিক থেকেই খেয়াল রাখতে হবে।

কুরবানীর পশু নির্বাচন ও তার খরচ

পশুর ধরন ও বয়স

কুরবানীর জন্য পশু নির্বাচনের ক্ষেত্রেও শরীয়াহ নির্ধারিত কিছু শর্ত আছে। গরু, ছাগল, ভেড়া, উট ইত্যাদি কুরবানীর উপযুক্ত পশু হিসেবে গৃহীত। তবে তাদের বয়স হতে হবে নির্দিষ্ট।

  • ছাগল ও ভেড়ার বয়স কমপক্ষে ১ বছর (কিন্তু যদি ৬ মাস বয়সী পশু দেখতে ১ বছরের মতো হয়, তবে জায়েজ)
  • গরুর বয়স হতে হবে ২ বছর পূর্ণ
  • উটের বয়স হতে হবে ৫ বছর

পশু অবশ্যই সুস্থ ও নির্দোষ হতে হবে। এক চোখ অন্ধ, পা খোঁড়া, অত্যন্ত দুর্বল বা অসুস্থ পশু কুরবানী করা জায়েজ নয়।

পশুর মূল্য ও বাজেট নির্ধারণ

২০২৫ সালের বাজারে গরুর দাম ধরা হচ্ছে গড়ে ৮০,০০০ থেকে ১,৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত। ছাগলের দাম ১৫,০০০ থেকে ৪০,০০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। একজন ব্যক্তি একা একটি গরু কিনতে না পারলে ৭ জন মিলে একটি গরু কুরবানী করতে পারেন। এতে ব্যয় ভাগ হয়ে যায় এবং সহজে কুরবানী দেওয়া সম্ভব হয়।

যদি আপনার কাছে নিসাব পরিমাণ টাকা থাকে, তবে পশু নির্বাচনের সময় আপনার সক্ষমতা অনুযায়ী বাজেট ঠিক করতে হবে। মনে রাখতে হবে, এই ইবাদত আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। তাই পশু যতটুকু সম্ভব উত্তম এবং সুন্দর হওয়া উচিত।

কুরবানীর মাংস বণ্টনের নিয়ম

ইসলামী দৃষ্টিতে বণ্টনের সঠিক পদ্ধতি

কুরবানীর মূল শিক্ষা হলো ত্যাগ এবং সহানুভূতি। তাই কুরবানীর মাংস তিন ভাগে ভাগ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ইসলামি শরীয়তে। এই তিন ভাগ হলো:

  1. এক ভাগ নিজে খাওয়ার জন্য
  2. এক ভাগ আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের জন্য
  3. এক ভাগ গরিব-মিসকিনদের জন্য

এই নিয়মটি কঠোরভাবে অনুসরণ না করলেও ইসলামের আদর্শ হচ্ছে অন্যদেরকে উপহার দেওয়া ও সহযোগিতা করা। বিশেষ করে গরীবদের অধিকার কুরবানীর মাংসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মাংস যদি পুরোটা নিজের জন্য রেখে দেওয়া হয়, তাহলে কুরবানীর মূল শিক্ষা ম্লান হয়ে যায়।

বিভিন্ন হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজ হাতে মাংস বণ্টন করতেন এবং সাহাবিদেরকে গরিবদের কথা স্মরণ রাখতে বলতেন। আজকের সময়ে যেখানে অনেকেই মাংস জমিয়ে রেখে দেন বা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন, সেখানে এই মূলনীতি যেন আমরা না ভুলি।

বণ্টনের আধুনিক প্রেক্ষাপট

বর্তমানে কুরবানীর মাংস বিতরণে কিছু সমস্যা দেখা যায়—কখনো দেখা যায়, অপ্রয়োজনীয় মানুষকেও দেওয়া হয় শুধু সম্পর্ক রক্ষার জন্য, আবার গরীবদের ভাগ ঠিকভাবে পৌঁছায় না। এ ব্যাপারে সঠিক দিকনির্দেশনা ও আত্ম-সমালোচনা জরুরি। অনেকে শহরে থাকার কারণে আত্মীয়স্বজন বা গরীবদের উপস্থিতি না পেয়ে পুরো মাংস নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। এই ক্ষেত্রে মাংস সংরক্ষণ করে পরবর্তীতে বিতরণ করাও একটি উপায় হতে পারে।

বর্তমানে অনলাইন ভিত্তিক কুরবানীর ব্যবস্থা বৃদ্ধি পেয়েছে। সেখানেও অনেক সময় বণ্টনের সঠিক নিয়ম মানা হয় না। কাজেই আপনি যদি অনলাইন কুরবানী করেন, নিশ্চিত হতে হবে—ওরা কি ইসলামী বিধান মেনে বণ্টন করছে কিনা।

কুরবানীর বিকল্প কোনো ইবাদত কি আছে?

সদকা ও ফিদিয়া কুরবানীর স্থলাভিষিক্ত নয়

অনেকেই মনে করেন, যদি কুরবানী না করা সম্ভব না হয়, তাহলে তার পরিবর্তে দান-খয়রাত করে দিলেই হবে। কিন্তু শরীয়ত অনুযায়ী, কুরবানী একটি নির্দিষ্ট ইবাদত, যার পরিবর্তে অন্য কিছু করা যাবে না যদি কুরবানী ওয়াজিব হয়। অর্থাৎ, নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে কুরবানী দান কিংবা সদকা দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়।

হাদীস অনুযায়ী, “যে ব্যক্তি কুরবানী করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তা করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।” (ইবনে মাজাহ)। এটি প্রমাণ করে, কুরবানী একটি বড় ইবাদত, যার কোন বিকল্প নেই।

অক্ষমদের জন্য করণীয়

তবে কেউ যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক না হন, তাদের জন্য কুরবানী ফরজ বা ওয়াজিব নয়। তাদের পরিবর্তে কুরবানী না করলেও কোনো গুনাহ হবে না। তারা ইচ্ছা করলে দান-সদকা করতে পারেন, যা নেকি অর্জনের একটি মাধ্যম হতে পারে। বিশেষ করে যারা সৎভাবে চেষ্টা করেও কুরবানী দিতে পারছেন না, তাদের জন্য সদকা একটি বিকল্প নয় বরং পুণ্যের সুযোগ।

নারী ও শিশুদের জন্য কুরবানীর বিধান

নারীদের জন্য ইসলামী দৃষ্টিকোণ

যদি কোনো নারীর ব্যক্তিগতভাবে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে, তাহলে তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব হয়, স্বামী বা পিতার ওপর নির্ভর করে নয়। অনেকে ভুলবশত ভাবেন নারীরা কুরবানী দিতে পারবেন না বা শুধু পুরুষদের কাজ এটি, যা একেবারেই ভ্রান্ত ধারণা।

ইসলামী শরীয়তে নারীদের ইবাদতের অধিকার পুরুষদের মতোই। তবে বাস্তবে দেখা যায়, অনেক নারী নিজের স্বর্ণালংকার বা নগদ অর্থের মালিক হয়েও কুরবানী এড়িয়ে যান, কারণ তারা ভাবেন এসব তো স্বামী খরচ করছে না। এখানে ইসলাম বলে, যদি নারীর নিজের মালিকানায় নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে এবং অন্যান্য শর্ত পূরণ হয়, তাহলে কুরবানী ওয়াজিব হয়ে যাবে।

শিশুদের জন্য বিধান

শিশুরা যেহেতু বালেগ নয়, তাই তাদের ওপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। তবে অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের নামে কুরবানী দিয়ে থাকেন, যা বৈধ এবং নেক কাজ হিসেবে ধরা হয়। এটি মূলত নফল বা ইচ্ছাকৃত কুরবানীর পর্যায়ে পড়ে।

তবে ইসলামে শিশুর জন্য জোর করে কুরবানী করানো কোনো ফরজ বা ওয়াজিব নয়। শিশুর পক্ষ থেকে কুরবানী দেওয়া হলে সেটা বাবা-মায়ের পক্ষ থেকে দান ও ইবাদতের মানসে হয়ে থাকে। এটি একদিক থেকে সন্তানের জন্য বরকত এবং অভিভাবকের জন্য পুণ্যের পথও বটে।

কুরবানী বিষয়ক ভুল ধারণা ও বাস্তবতা

প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা

অনেকেই মনে করেন কুরবানী শুধু ধনী মানুষের জন্য, যা ঠিক নয়। এটি একান্তভাবে নির্ধারিত হয়েছে সম্পদের পরিমাণ অনুসারে, সমাজের অর্থনৈতিক শ্রেণী অনুযায়ী নয়। কিছু ভুল ধারণা হলো:

  • শুধু পুরুষরা কুরবানী করতে পারে
  • গরীব বা মধ্যবিত্তরা কুরবানী করতে পারবে না
  • কুরবানীর টাকা দিয়ে দান করলে ইবাদত সম্পন্ন হয়
  • একটি পরিবারে একজন কুরবানী করলেই সবাই মুক্ত

এইসব ধারণা ইসলামিক জ্ঞানের অভাব থেকে আসে এবং তা থেকে মুক্ত থাকতে হলে কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকা জরুরি।

বাস্তবিক চিত্র ও সচেতনতা

বর্তমানে সচেতনতা বাড়লেও এখনো অনেক মুসলিম কুরবানীর ইবাদতকে যথাযথ গুরুত্ব দেন না। কেউ কেউ দেখানোর জন্য কুরবানী করেন, আবার কেউ টাকা থাকার পরও এড়িয়ে যান। ইসলাম চায় এক আন্তরিক ইবাদত, যার মধ্যে থাকবে একাগ্রতা, ত্যাগ এবং আত্মশুদ্ধি।

উপসংহার

কুরবানী কোনো বিলাসিতা নয়, বরং একটি মহান দায়িত্ব ও ইবাদত, যা আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা এবং আনুগত্য প্রকাশের প্রতীক। একজন মুসলিম যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হন এবং অন্য শর্তগুলো পূরণ করেন, তাহলে তার জন্য কুরবানী ওয়াজিব। নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই এই বিধান প্রযোজ্য। কুরবানী করে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি এবং সমাজে গরীবদের সাথেও আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারি। আসুন আমরা এই ইবাদতকে যথাযথভাবে পালন করি এবং ভুল ধারণা থেকে নিজেকে ও অন্যদের মুক্ত রাখি।

FAQs

১. ২০২৫ সালে কুরবানীর জন্য কত টাকা থাকলে ওয়াজিব হবে?

রূপার ভিত্তিতে নিসাব ধরা হলে আনুমানিক ৬,৩০০ টাকা থাকলে কুরবানী ওয়াজিব হবে। তবে এটি বাজারদর অনুযায়ী পরিবর্তন হতে পারে।

২. একজন নারী কি কুরবানী করতে পারে?

হ্যাঁ, যদি তার নিজস্ব নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে তবে তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব।

৩. শিশুদের জন্য কুরবানী কি করতে হয়?

না, বালেগ না হওয়ায় তাদের ওপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। তবে বাবা-মা ইচ্ছায় করতে পারেন।

৪. কুরবানীর পরিবর্তে দান করলে হবে কি?

না, যদি কুরবানী ওয়াজিব হয় তবে দান-খয়রাত দ্বারা তা পূর্ণ হবে না।

৫. এক পরিবারের একজন কুরবানী করলে কি সব সদস্যের হয়ে যাবে?

না, প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক, নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক ব্যক্তির জন্য আলাদা কুরবানী ওয়াজিব।

About the author

Daud
Hey! I'm Daud, Currently Working in IT Company BD. I always like to learn something new and teach others.

Post a Comment

To avoid SPAM, all comments will be moderated before being displayed.
Don't share any personal or sensitive information.