ভূমিকা
জ্বরজনিত খিঁচুনি কী?
জ্বরজনিত খিঁচুনি (ফেব্রাইল কনভালশন) হচ্ছে কোনো শিশুর শরীরে জ্বর বেড়ে গেলে আকস্মিকভাবে স্নায়ুতন্ত্র উত্তেজিত হয়ে ঘটতে পারে এমন খিঁচুনি। সাধারণত ৬ মাস থেকে ৫ বছরের মধ্যে দেখা যায়। খিঁচুনির সময় শিশু ভুলভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ করে ফেলায় অভিভাবকরা ভয়ে হতবাক হন, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটি স্বল্পস্থায়ী এবং স্থায়ী মস্তিষ্কগত ক্ষতি ঘটায় না।
শিশুদের উপর এর প্রভাব
খিঁচুনি ঘটলে শিশু কিছু মিনিটের জন্য অচেতন হতে পারে, পেশীতে ঝাঁকুনি দেখা দিতে পারে বা চোখের চাহনি আলাদা হতে পারে। এ ধরনের ঘটনা অভিভাবকদের মনে অনেক শঙ্কা জাগায় — তবে সঠিক প্রাথমিক চিকিৎসা ও ডাক্তারের নির্দেশনা মেনে চললে অধিকাংশ শিশুই স্বাভাবিকভাবে সেরে উঠে।
জ্বরজনিত খিঁচুনির চিকিৎসা
১. জ্বর নিয়ন্ত্রণ
প্রথম পদক্ষেপ হলো জ্বর কমানো। জ্বরজনিত খিঁচুনির ক্ষেত্রে জ্বরই মূল কারণ—তাই শিশুর বয়স ও ওজন অনুযায়ী প্যারাসিটামল (ডাক্তার নির্দিষ্ট ডোজে) দিয়ে জ্বর দ্রুত কমাতে হবে। ঘরেই হালকা স্পঞ্জিং (কাঙ্খিত তাপমাত্রার পানি) করা যেতে পারে যদি ডাক্তারের নির্দেশ অনুযায়ী করা হয়।
২. খিঁচুনি বন্ধের ওষুধ
খিঁচুনি থামাতে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ডায়াজিপাম গ্রুপ (মুখে বা মাপ অনুযায়ী রেক্টাল/ইভেন) ইত্যাদি ওষুধ ব্যবহার করা হয়। তবে ওষুধ ব্যবহার সবসময় ডাক্তারের পরামর্শে করতে হবে — ভুল ডোজ বা অননুমোদিত ওষুধ দিয়েলে সমস্যা বাড়তে পারে।
৩. কারণ নির্ণয় এবং পরবর্তী চিকিৎসা
খিঁচুনি হলে ডাক্তারের পরামর্শে প্রয়োজনীয় পরীক্ষানিরীক্ষা (রক্ত পরীক্ষা, সঠিক ইতিহাস, কখন খিঁচুনি হচ্ছে ইত্যাদি) করে জ্বরের কারণ নির্ণয় করে তা প্রতিকার করতে হবে। শুধুমাত্র খিঁচুনি বন্ধ করলেই হবে না—মূল জ্বরের কারণ আবিষ্কার ও তা নিরাময় করাও জরুরি।
প্রতিরোধ
১. দ্রুত জ্বর কমানো
ফেব্রাইল কনভালশন রোগে আক্রান্ত শিশুদের জ্বর হওয়া মাত্রই তাদের বয়স ও ওজন অনুযায়ী প্যারাসিটামল খাইয়ে জ্বর নিচু করা প্রাথমিক প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। জ্বর যত দ্রুত নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হবে, খিঁচুনির ঝুঁকি ততই কমে যাবে।
২. অভিভাবকের সতর্কতা
যেকোনো সময় শিশুর জ্বর উঠতে পারে—অতএব অভিভাবকদের সবসময় সতর্ক থাকা উচিত। জ্বর কমানোর ওষুধ, ডাক্তারের ফোন নম্বর, এবং প্রাথমিক চিকিৎসার জ্ঞান রাখলে জরুরি মুহূর্তে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব।
৩. ভ্রমণের সময় করণীয়
যদি এ ধরনের শিশুকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যান, তখন প্যারাসিটামল সিরাপ এবং ডাক্তার কর্তৃক দেওয়া খিঁচুনি বন্ধ করার ব্যবস্থাপত্র সঙ্গে রাখুন। প্রয়োজনে চিকিৎসকের দেওয়া ইমার্জেন্সি নির্দেশাও কপিতে রাখুন।
ভবিষ্যতে মৃগীরোগ (এপিলেপসি) হওয়ার ঝুঁকি
সাধারণভাবে কী ঘটে?
সাধারণত ফেব্রাইল কনভালশন থেকে মস্তিষ্কে স্থায়ী ক্ষতি হয় না এবং অধিকাংশ শিশুরই ভবিষ্যতে এপিলেপসি বা মৃগীরোগ হওয়ার ঝুঁকি খুবই কম। তবে কিছু ক্ষেত্রে ঝুঁকি একটু বেশি দেখা যায়—নিচে সেই কারণগুলো দেওয়া হয়েছে।
ঝুঁকি বাড়ায় এমন অবস্থা
নিম্নলিখিত শারীরিক বা পারিবারিক ইতিহাস থাকলে ভবিষ্যতে এপিলেপসির ঝুঁকি বাড়তে পারে:
- শিশুর স্নায়ুর বিকাশজনিত কোনো সমস্যা থাকলে।
- পরিবারে কারও আগে থেকে মৃগীরোগ থাকলে।
- জ্বরের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে একাধিকবার খিঁচুনি হলে বা একবারে ১৫ মিনিটের বেশি খিঁচুনি হলে।
- খিঁচুনি হাত-পা নয়, বরং শরীরের কোনো এক পাশে থেকে শুরু করলে।
এসব লক্ষণ থাকলে অবশ্যই শিশুকে শিশু স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ-এর কাছে পরীক্ষা করানো উচিত।
ব্যবহারিক টিপস ও সতর্কতা
আতঙ্কিত না হয়ে ডাক্তারের পরামর্শ পালন করলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জ্বর ও খিঁচুনি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। ৬ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে জ্বরের সঙ্গে খিঁচুনি হলে দ্রুত বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।
উপসংহার
জ্বরজনিত খিঁচুনি ভয়ংকর দেখাতে পারে, কিন্তু সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা নিলে এটি নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হয় না। অভিভাবক হিসেবে সতর্ক থাকা, প্রয়োজনীয় ওষুধ সঙ্গে রাখা এবং ডাক্তারি পরামর্শ মেনে চলাই মূল কথা।
প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)
প্রশ্ন ১: ফেব্রাইল কনভালশন কি সারাজীবন সমস্যা?
সাধারণত না—অধিকাংশ শিশুর এক বা দুইবার খিঁচুনি হয়ে পরে আর কোনো দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হয় না। তবে নির্দিষ্ট ঝুঁকি উপস্থিত থাকলে বিশেষজ্ঞকে দেখাতে হবে।
প্রশ্ন ২: শিশুর জ্বর হলে প্রথমে কী করব?
শিশুর বয়স ও ওজন অনুযায়ী ডাক্তারের পরামর্শমত প্যারাসিটামল দিন, শিশুকে শান্ত রাখুন, আর প্রয়োজনে চিকিৎসা গ্রহণ করুন। খিঁচুনি শুরু হলে শিশু যেন আঘাত না পায় সে ব্যবস্থা নিন এবং জরুরি অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া উচিত।
প্রশ্ন ৩: ফেব্রাইল কনভালশন কি পরে এপিলেপসিতে রূপ নিতে পারে?
সাধারণত ঝুঁকি কম, কিন্তু যদি পরিবারে মৃগীরোগের ইতিহাস থাকে বা খিঁচুনি দীর্ঘস্থায়ী/একাধিকবার হয়, তাহলে পরবর্তীতে এপিলেপসির ঝুঁকি বাড়তে পারে।
প্রশ্ন ৪: ওষুধ ছাড়া কি খিঁচুনি থামানো যায়?
খিঁচুনি চলাকালীন প্রধান লক্ষ্য হলো শিশুকে নিরাপদ রাখা—তাকে কোনো ধারালো বস্তু থেকে দূরে রাখা, মাথা সুরক্ষিত রাখা ও শ্বাসপ্রশ্বাস নিশ্চিত করা। ডায়াজিপাম প্রভৃতি ওষুধ প্রয়োজন হলে সেটি ডাক্তারের পরামর্শে ব্যবহার করতে হবে।
প্রশ্ন ৫: বাড়িতে কি কি সামগ্রী রাখা উচিত?
প্যারাসিটামল সিরাপ (ডাক্তারের অনুমোদিত ডোজ সহ), চিকিৎসকের নম্বর, জরুরি নির্দেশাবলী কপি, এবং জরুরি সময়ে নিরাপদভাবে শিশু রাখার জ্ঞাণ থাকা জরুরি।
যেকোনো সন্দেহ বা খিঁচুনির ক্ষেত্রে দ্রুত pediatrician বা শিশু স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।