সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের নিয়ম, সীমা ও মুনাফার হার ২০২৫ | National Savings Certificate Bangladesh

বাংলাদেশে সঞ্চয়পত্র কেনা, বিনিয়োগের সীমা, মুনাফার হার ও ভাঙানোর নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন — নিরাপদ বিনিয়োগের সর্বশেষ তথ্য ২০২৫ অনুযায়ী।সঞ্চয়পত্র ব

সংক্ষেপে : গত কয়েক বছরে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে টাকা ফেরত না দেওয়ার ঘটনা বেড়েছে। কিছু ক্ষেত্রে ঋণের নামে অর্থ লুটপাট করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে, যার ফলে ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্য ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে এবং সাধারণ গ্রাহকরা তাদের টাকা ফেরত পেতে ঝামেলায় পড়ছেন। এই পরিস্থিতিতে নিরাপদ এবং নির্ভরযোগ্য বিনিয়োগ হিসেবে সঞ্চয়পত্র ব্যাপক প্রাধান্য পায় — যেখানে মূলধন ফিরবে এবং মুনাফাও নিশ্চিত থাকে।

কোন ধরনের সঞ্চয়পত্র আছে?

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর বর্তমানে চার ধরনের সঞ্চয়পত্র পরিচালনা করে — পরিবার সঞ্চয়পত্র, পেনশনার সঞ্চয়পত্র, পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র এবং তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র। পরিবার সঞ্চয়পত্র ব্যতীত বাকি তিনটি সঞ্চয়পত্রে ব্যক্তিগত পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানও বিনিয়োগ করতে পারে। প্রতিটি সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ, ক্রয়যোগ্য পরিমাণ এবং যোগ্যতা ভিন্ন।

সর্বোচ্চ কত টাকার সঞ্চয়পত্র কেনা যাবে?

সামগ্রিক সীমা: একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ একক নামে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে পারবেন (পেনশনার সঞ্চয়পত্রের শীর্ষসীমা একক হিসেবে ৫০ লাখ)। অন্য সঞ্চয়পত্রগুলোতেও পৃথক সর্বোচ্চ সীমা প্রযোজ্য। নিচে প্রতিটি সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে বিস্তারিত দেওয়া হলো।

পরিবার সঞ্চয়পত্র

সর্বোচ্চ সীমা: পরিবার সঞ্চয়পত্র সর্বোচ্চ ৪৫ লাখ টাকা মূল্যের পর্যন্ত কেনা যাবে। তবে এটি মূলত প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের জন্য উন্মুক্ত। বিশেষ ছাড় রয়েছে — যেকোনো বাংলাদেশি শারীরিক প্রতিবন্ধী নারী-পুরুষ এবং ৬৫ ও তদূর্ধ্ব বয়সের যেকোনো বাংলাদেশি নাগরিক পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনতে পারবেন। পরিবার সঞ্চয়পত্র সাধারণত পরিবারের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ও নির্দিষ্ট মেয়াদে ভর্তুকিভিত্তিক মুনাফার সুবিধা দেয়।

পেনশনার সঞ্চয়পত্র

সর্বোচ্চ সীমা ও যোগ্যতা: একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত পেনশনার সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন—এটি একক নামে সর্বোচ্চ বিনিয়োগসীমা। এই সঞ্চয়পত্র কেনার যোগ্য ব্যক্তি হলেন: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী, সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য এবং মৃত চাকরিজীবীর পারিবারিক পেনশনভোগী স্বামী/স্ত্রী/সন্তান।

ব্যবহারিক মূল্যমান: পেনশনার সঞ্চয়পত্র ৫০ হাজার টাকার থেকে শুরু করে ৫০ লাখ টাকার পর্যন্ত ক্রয় করা যায়।

পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র

সর্বোচ্চ সীমা: একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে পারবেন। এই সঞ্চয়পত্র সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি সেভিংস ও স্থিতিশীল রিটার্নের জন্য পছন্দ করা হয়। মূল্যমান ১০ টাকা থেকে ২৫ লাখ টাকার স্কেলে উপলব্ধ।

তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র

সর্বোচ্চ সীমা: তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারবেন। এই সঞ্চয়পত্রের মূল্যমান সাধারণত ১ লাখ টাকা থেকে ১০ লাখ টাকার মধ্যে থাকে। নিয়মিত আয়ের উৎস হিসেবে এটি জনপ্রিয় কারণ প্রত্যেক তিন মাস পর মুনাফা ধারণা করা হয়।

 National Savings Certificate

একজন ব্যক্তি সর্বমোট কত পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারবেন?

নিয়ম: সব মিলিয়ে যদি আপনি একটি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে চান, তবে সর্বোচ্চ সীমা পেনশনার সঞ্চয়পত্রের ৫০ লাখ টাকা—অর্থাৎ একক নামে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ সম্ভব। তবে ব্যক্তিগত প্রোফাইল ও যোগ্যতা অনুযায়ী পরিবারের অন্যান্য সঞ্চয়পত্রেও আলাদা সীমা প্রযোজ্য। নীতিমালা অনুসারে প্রত্যেক সঞ্চয়পত্রের মূল্যমান ভিন্ন, তাই ক্রয় করার আগে উপযুক্ত কাগজপত্র ও যোগ্যতা যাচাই করে নিন।

আরও পড়ুনঃ

কোথা থেকে কিনতে বা ভাঙতে পারবেন?

কেনাবিক্রি কেন্দ্র: জাতীয় সঞ্চয় ব্যুরো, বাংলাদেশ ব্যাংকের শাখা, বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখা এবং ডাকঘর থেকে আপনি এই সঞ্চয়পত্রগুলো ক্রয় ও ভাঙাতে পারবেন। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে প্রক্রিয়া ভিন্ন হতে পারে—তাই ক্রয়ের সময় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মেনে চলুন এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সঙ্গে রাখুন।

মুনাফা হার (বর্তমান বিবরণ)

মোট ধারণা: সঞ্চয়পত্রগুলোর মুনাফা হার সাধারণত বিনিয়োগের পরিমান অনুযায়ী ছোট-বড় ভাগে নির্ধারিত হয়। সাধারণত সাড়ে সাত লাখ টাকার কম এবং বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা মুনাফা হার থাকে। নিচে প্রতিটি সঞ্চয়পত্রের মুনাফা হার সংক্ষিপ্তভাবে দেওয়া হলো।

পরিবার সঞ্চয়পত্রের মুনাফা

মেয়াদ পূর্তিতে: পরিবার সঞ্চয়পত্রে যদি বিনিয়োগ সাড়ে সাত লাখ টাকার কম হয়, তাহলে পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্তিতে মুনাফার হার নির্ধারিত হয়েছে ১১.৯৩%। আর যদি সাড়ে সাত লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ করা হয়, তখন মুনাফা হার হয় ১১.৮০%। এই দুই স্তরে বিনিয়োগের উপর নির্ভর করে রিটার্ন নির্ধারণ করা হয়।

পেনশনার সঞ্চয়পত্রের মুনাফা

মেয়াদ পূর্তিতে: পেনশনার সঞ্চয়পত্রে সাড়ে সাত লাখ টাকার কম বিনিয়োগ থাকলে পঞ্চম বছর শেষে মুনাফার হার ১১.৯৮%—এটি সঞ্চয়পত্রগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ নির্ধারিত হার। আর সাড়ে সাত লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ করলে মুনাফা হার ১১.৮০%। পেনশনার সঞ্চয়পত্র সাধারণত রিটায়ারড ব্যক্তিদের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিকল্প, কারণ রিটার্ন উচ্চ এবং ঝুঁকি কম।

পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের মুনাফা

মেয়াদ পূর্তিতে: পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে সাড়ে সাত লাখ টাকার কম বিনিয়োগে মুনাফা হার ১১.৮৩% এবং সাড়ে সাত লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে ১১.৮০% নির্ধারিত আছে। এটি দীর্ঘমেয়াদি সেভিংস হিসেবে স্থির ও নির্ভরযোগ্য বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হয়।

তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের মুনাফা

মেয়াদ পূর্তিতে: তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে সাড়ে সাত লাখ টাকার কম বিনিয়োগে মেয়াদ পূর্তিতে মুনাফার হার ১১.৮২% এবং সাড়ে সাত লাখের বেশি বিনিয়োগে মুনাফা হার ১১.৭৭% রাখা হয়েছে। এই সঞ্চয়পত্র মাসিক/ত্রৈমাসিক আয় প্রীতসঞ্চয়কারীদের জন্য বেশ উপযোগী।

মেয়াদ পূর্তির আগে সঞ্চয়পত্র ভাঙলে কী ঘটে?

প্রভাব: মেয়াদ পূর্তির আগে সঞ্চয়পত্র ভাঙলে মুনাফার হার কমে যায়। অর্থাৎ আপনি সম্পূর্ণ সম্মানিত মুনাফা পাবেন না; সেক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত পূর্ব-ভাঙার শাস্ত্র অনুযায়ী হারে কাটা হবে। তাই জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মেয়াদ পূর্তির আগে সঞ্চয়পত্র ভাঙা পরামর্শযোগ্য নয়। যদি জরুরি প্রয়োজনে ভাঙতেই হয়, ভাঙার নিয়ম, কাগজপত্র ও ছাড়ের হার আগে থেকে যাচাই করে নিন।

সঞ্চয়পত্র কেনার আগে বিবেচ্য বিষয়

  1. আপনার লক্ষ্য নির্ধারণ করুন: স্বল্পমেয়াদি প্রয়োজন নাকি দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয়—তার উপর ভিত্তি করে সঠিক সঞ্চয়পত্র বাছাই করুন।
  2. মেয়াদ ও তরলতা বিবেচনা: আগেই টাকা তুলতে হতে পারে কি না, তা মাথায় রাখুন—কিছু সঞ্চয়পত্র মেয়াদ পর্যন্ত আটকে রাখতে পারে বা আগেই ভাঙলে কাটা থাকবে।
  3. মুনাফার হার মূল্যায়ন: বিভিন্ন স্তরের মুনাফা হার এবং বড় পরিমাণ বিনিয়োগে হার কমে কি না তা বিবেচনা করুন।
  4. যোগ্যতা যাচাই: বিশেষ সঞ্চয়পত্র (যেমন পরিবার সঞ্চয়পত্র, পেনশনার সঞ্চয়পত্র) কেনার জন্য নির্দিষ্ট যোগ্যতা লাগতে পারে—সেগুলো আগে দেখে নিন।
  5. বিকল্প বিবেচনা: ব্যাংক ফিক্সড ডিপোজিট, মিউচুয়াল ফান্ড ইত্যাদি বিকল্পের তুলনায় ঝুঁকি-রিটার্ন মূল্যায়ন করে সিদ্ধান্ত নিন।

উপসংহার

সিদ্ধান্ত: ব্যাংকিং খাতে অনিশ্চয়তা বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে সঞ্চয়পত্র অনেকের কাছে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে আসছে। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করলে মূলধন ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকে এবং নির্দিষ্ট হার অনুসারে মুনাফাও পাওয়া যায়। তবে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যক্তির প্রয়োজন, মেয়াদ, তরলতা ও যোগ্যতা বিবেচনা করে উপযুক্ত সঞ্চয়পত্র বেছে নেওয়া উচিত। মেয়াদ পূর্তির আগে ভাঙলে মুনাফা কমে যায় — তাই জরুরি প্রয়োজন না হলে মেয়াদ পর্যন্ত রাখা উপকারী।

প্রায়শই জিজ্ঞাস্য (FAQs)

১। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করলে কি ডকুমেন্ট লাগবে?

উত্তর: হ্যাঁ — সাধারণত জাতীয় পরিচয়পত্র, যেমন জাতীয় পরিচয়পত্র/পাসপোর্ট/জন্মনিবন্ধন (যদি প্রযোজ্য) এবং পিন্ড-ঠিকানা প্রমাণ ইত্যাদি প্রয়োজন হয়। পেনশনার সঞ্চয়পত্রের জন্য অতিরিক্ত পেনশন প্রমাণপত্র বা অবসরের কাগজপত্র লাগতে পারে।

২। সঞ্চয়পত্র বিক্রি বা ভাঙতে কোথায় যেতে হবে?

উত্তর: জাতীয় সঞ্চয় ব্যুরো, বাংলাদেশ ব্যাংকের শাখা, বাণিজ্যিক ব্যাংক নিকটস্থ শাখা বা ডাকঘর থেকেও সঞ্চয়পত্র ক্রয় ও ভাঙানো যায়। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে প্রক্রিয়া ভিন্ন হতে পারে তাই পূর্বে যোগাযোগ করে নির্দেশনা নেওয়া উত্তম।

৩। আমি কি একজন প্রতিষ্ঠান হিসেবে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে পারি?

উত্তর: পরিবার সঞ্চয়পত্র ব্যতীত বাকি সমস্ত সঞ্চয়পত্রে প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করতে পারে—তবে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক শর্তাবলী ও নথিপত্র প্রযোজ্য হবে।

৪। কি কারণে মেয়াদ পূর্তির আগে সঞ্চয়পত্র ভাঙা অনুপযুক্ত?

উত্তর: মেয়াদ পূর্তির আগে ভাঙলে সরকার নির্ধারিত বিধি অনুযায়ী মুনাফা হারে কাটতি হবে, ফলে আপনি পূর্ণ মুনাফা পাবেন না। তাই জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মেয়াদ পর্যন্ত রাখা সেরা।

৫। সঞ্চয়পত্র কি করমুক্ত বা কর-ব্যবহারযোগ্য?

উত্তর: সঞ্চয়পত্রের উপর ফোর্স বা কর সংক্রান্ত বিধি সময় ও নীতিমালা অনুযায়ী পরিবর্তিত হতে পারে। বিনিয়োগের আগে সাম্প্রতিক করনীতিগত দিকগুলো যাচাই করে নিন বা ট্যাক্স অ্যাডভাইজারের পরামর্শ নিন।

নোট: এখানে প্রদত্ত মুনাফার হার ও সীমাবদ্ধতা সময় ও নীতিমালার পরিবর্তন অনুযায়ী সময়ভিত্তিকভাবে পরিবর্তিত হতে পারে। সঠিক ও হালনাগাদ তথ্যের জন্য সর্বদা জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর বা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের অফিসিয়াল নোটিশ দেখুন।

About the author

Leo
Hey! I'm Leo. I'm always eager to learn new things and enjoy sharing my knowledge with others.

Post a Comment

To avoid SPAM, all comments will be moderated before being displayed.
Don't share any personal or sensitive information.