বাংলাদেশে মিড ডে মিল কর্মসূচি ২০২৫ — প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পুষ্টিকর খাবার | School Feeding Programme

বাংলাদেশে ১৫ নভেম্বর ২০২৫ থেকে শুরু হলো মিড ডে মিল কর্মসূচি। দেশের ১৯,৪১৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩১ লাখ শিক্ষার্থী প্রতিদিন পাবে পুষ্টিকর খাবার
 School Feeding Programme

মিড ডে মিল: দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় নতুন এক যুগ

আজ থেকে (১৫ নভেম্বর ২০২৫) দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করা হলো ‘মিড ডে মিল’ বা School Feeding Programme — একটি ঐতিহাসিক উদ্যোগ যার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ শিশু প্রতিদিন স্কুলে বসেই পুষ্টিকর খাবার পাবেন। এটি কেবল খাবার বিতরণ নয়; এটি শিক্ষা ও পুষ্টি নিশ্চিত করার একটি বড় পদক্ষেপও বটে।

উদ্বোধন ও কোথায় শুরু

আজ সকালে নাটোর জেলার গুরুদাসপুর উপজেলার খুবজীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে এই কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু তাহের মো. মাসুদ রানা, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু নূর মো. শামসুজ্জামান, প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাগণ।

কতজন সুবিধাভোগী — কর্মসূচির প্রথম পর্যায়

প্রথম পর্যায়ে এই কর্মসূচি দেশের নির্বাচিত ১৫০টি উপজেলা-র মোট ১৯,৪১৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়-এ চালু করা হচ্ছে। এর আওতায় মোট ৩১,১৩,০০০ (তিন কোটি তেরো হাজার) শিক্ষার্থী প্রতিদিন পুষ্টিকর খাবার পাবে।

সংক্ষেপে তথ্য

তথ্য ও বিস্তারিতঃ

মোট উপজেলা: ১৫০টি

মোট বিদ্যালয়: ১৯,৪১৯টি

মোট শিক্ষার্থী: ৩১,১৩,০০০

প্রকল্পের মেয়াদ: ডিসেম্বর ২০২৭ পর্যন্ত

বাস্তবায়নকারী: প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর

আরও পড়ুনঃ

বিশেষভাবে অন্তর্ভুক্ত অঞ্চল

বান্দরবান ও কক্সবাজারসহ দেশের সব উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এই কর্মসূচির আওতাভুক্ত করা হয়েছে, যা ভৌগোলিকভাবে প্রতিবন্ধকতা থাকা এলাকাগুলোকেও অবহিত করে।

প্রতিদিনের খাবার ও পুষ্টিগত কাঠামো

সাপ্তাহিক খাবার তালিকা

মিড ডে মিল কর্মসূচির অধীনে শিক্ষার্থীরা সপ্তাহের পাঁচ কর্মদিবসে বিভিন্ন পুষ্টিকর খাবার পাবে। খাবার তালিকা এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে শিশুরা প্রয়োজনীয় ক্যালোরি, প্রোটিন ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট পায়।

  1. রবিবার: ১২০ গ্রাম বনরুটি এবং সিদ্ধ ডিম
  2. সোমবার: বনরুটি এবং ২০০ গ্রাম UHT দুধ (আল্ট্রা হাই টেম্পারেচার ট্রিটেড মিল্ক)
  3. মঙ্গলবার: ৭৫ গ্রাম ফর্টিফাইড বিস্কুট এবং কলা বা স্থানীয় মৌসুমি ফল
  4. বুধবার: বনরুটি এবং সিদ্ধ ডিম
  5. বৃহস্পতিবার: বনরুটি এবং সিদ্ধ ডিম

পুষ্টি অনুপাত (প্রাথমিক লক্ষ্য)

এই তালিকায় সংযুক্ত খাবারগুলোর মাধ্যমে মোট এনার্জির ২৫.৯%, মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের ৩২.২%, প্রোটিনের ১৬.৪% এবং ফ্যাটের ২১.৭% সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। অর্থাৎ একটি শিশু এখানে থেকে তার দৈনিক পুষ্টি চাহিদার গুরুত্বপূর্ণ অংশ পাবে, যা শিক্ষার মান এবং শারীরিক বৃদ্ধিতে সহায়ক।

কেন গুরুত্বপূর্ন এই কর্মসূচি?

প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানান—এই কর্মসূচির মূল লক্ষ্য হলো দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক, সমতাভিত্তিক এবং গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং একই সঙ্গে পুষ্টিকর খাদ্যের মাধ্যমে তাদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উন্নতি ঘটানো।

প্রত্যাশিত প্রভাব ও ফলাফল

সরকারি বিশ্লেষণ ও পরিকল্পনার আলোকে এই কর্মসূচি চালু হলে নিম্নোক্ত গুরুত্বপূর্ন পরিবর্তনগুলো আশা করা হচ্ছে:

  1. উপস্থিতির হার বৃদ্ধি: বিদ্যালয়ে শিশুদের উপস্থিতির হার শতকরা ৮০% ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। অনেক পরিবারে খাবারের অভাবে শিশুরা স্কুলে যেতে পারে না; মিড ডে মিল এ সমস্যার সমাধান করবে।
  2. ঝরে পড়া কমবে: খাবারের নিশ্চয়তা থাকায় দরিদ্র পরিবারের শিশুদের স্কুল ছেড়ে কাজে যাওয়ার অনুপ্রবণতা কমবে।
  3. ভর্তির হার বাড়বে: বার্ষিক প্রকৃত ভর্তির হার শতকরা ১০% বা তারও বেশি বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
  4. ধরে রাখার হার উন্নত হবে: বিদ্যালয়ে শিশুদের ধরে রাখার হার অন্তত ৯৯%-এ উন্নীত করার লক্ষ্য রয়েছে।
  5. ক্ষুধা ও পুষ্টিহীনতা হ্রাস: শিশুদের ক্ষুধা নিবারণ এবং পুষ্টি গ্রহণের হার ৯০%-এর বেশি বেড়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

শিক্ষার গুণগত মানে প্রভাব

পুষ্টিহীনতায় ভোগা শিশুদের ক্লাসে মনোযোগ কম থাকে ও শেখার সক্ষমতা সীমিত থাকে। সুশক্তি ও সুষম পুষ্টি তাদের মস্তিষ্কের বিকাশকে সহায়তা করে, মনোযোগ বাড়ায় এবং শেখার মান উন্নত করে। ফলে মিড ডে মিল একদিকে যেমন পুষ্টি নিশ্চয়তা দেয়, অন্যদিকে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিতেও সরাসরি অবদান রাখবে।

বাস্তবায়ন, মেয়াদ ও সম্প্রসারণ পরিকল্পনা

বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণ

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে এই কর্মসূচি পরিচালনা করবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে কড়া পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। নিয়মিত মনিটরিং-এর মাধ্যমে দেখা হবে যে প্রতিটি শিশু যথাযথ পরিমাণ ও মানের খাবার পাচ্ছে কিনা।

প্রকল্পের মেয়াদ ও পরবর্তী ধাপ

প্রকল্পটি বর্তমানে ডিসেম্বর ২০২৭ পর্যন্ত নির্ধারিত। এই সময়ের মধ্যে কর্মসূচির সফলতা মূল্যায়ন করে প্রয়োজনীয় সংশোধন, ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ধাপে ধাপে দেশের আরও বেশি উপজেলা ও বিদ্যালয়ে সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নেওয়া হবে। সফল হলে ভবিষ্যতে দেশের প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশু এই সুবিধা পাবে—এই লক্ষ্য স্থাপন করা হয়েছে।

সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব

মিড ডে মিল প্রোগ্রাম কেবল ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য নয়; এটি সমাজের প্রতিটি স্তরের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। দরিদ্র পরিবারগুলোর খাদ্য খরচ কমবে, মায়েরা আশ্বস্তভাবে তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে সক্ষম হবেন এবং স্থানীয় কৃষক ও সরবরাহকারীরা অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হবেন।

স্থানীয় অর্থনীতি ও সরবরাহ চেইন

খাবার সরবরাহের জন্য স্থানীয় বাজার ও কৃষকদের সাথে যুক্ত করে সরবরাহ চেইন তৈরি করলে স্থানীয় অর্থনীতিও জোরদার হবে। তাছাড়া উৎস নির্ভর খাদ্য সরবরাহ শিক্ষার্থীদের জন্য তাজা ও পুষ্টিকর উপকরণ নিশ্চিত করবে।

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা

সরকারি পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা, মনিটরিং রিপোর্ট এবং স্থানীয় কমিটির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে যে প্রতিটি শিশুর জন্য যে খাবার নির্ধারিত সেই মান ও পরিমাণ বজায় থাকে। অনিয়ম প্রতিহত করতে স্থানীয় পর্যায়ে জবাবদিহিতা বজায় রাখা হবে।

চ্যালেঞ্জ ও বিবেচ্য বিষয়

যদিও উদ্যোগটি রূপ নেয়া স্বাগত; তবুও কিছু বাস্তবচ্যালেঞ্জ রয়েছে—যেমন সরবরাহ চেইন ম্যানেজমেন্ট, তাজা ও নিরাপদ খাবার নিশ্চিতকরণ, অনিয়ম রোধ, এবং বহু দূরবর্তী বা পাহাড়ি অঞ্চলে কার্যকর বিতরণ তদারকি। এগুলো মোকাবিলায় কার্যকর মনিটরিং, স্থানীয় অংশীদারিত্ব এবং প্রযুক্তি ব্যবহার অপরিহার্য।

টেন্ডার ও প্রশাসনিক বাধা

দীর্ঘদিন ধরে টেন্ডার সংক্রান্ত জটিলতা এবং প্রশাসনিক কারণগুলো এই কর্মসূচির বাস্তবায়ন বিলম্বিত করেছিল। তবে এখন এসব বাধা কাটিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন শুরু হওয়ায় শিগগিরই কাঙ্খিত ফলাফল প্রত্যাশা করা হচ্ছে।

শেষ কথা

আজ থেকে চালু হওয়া ‘মিড ডে মিল’ কর্মসূচি বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি নতুন অধ্যায় শুরু করছে। এই উদ্যোগ কেবলভাবে শিশুদের পুষ্টি সমস্যা সমাধান করবে না—একই সঙ্গে একটি শিক্ষিত, সুস্থ এবং সক্ষম প্রজন্ম গঠনে ভিত্তি স্থাপন করবে। যখন একটি শিশু খালি পেটে স্কুলে যায়, তখন সে পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারে না; এখন থেকে ৩১ লাখের অধিক শিশু প্রতিদিন পুষ্টিকর খাবার পেয়ে আরও ভালোভাবে শিখতে পারবে।

সরকারের এই দূরদর্শী পদক্ষেপ দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শক্তিশালী করবে—এটি যদি সফলভাবে বাস্তবায়িত ও সম্প্রসারিত হয়, তবে অদূর ভবিষ্যতে দেশের প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশু এই সুবিধা পাবে বলে আশা করা যায়।

নোটঃ কর্মসূচির কার্যকর বাস্তবায়ন ও পুষ্টি নিশ্চিত করার জন্য নিয়মিত তদারকি, স্থানীয় অংশগ্রহণ এবং স্বচ্ছতা অপরিহার্য।

About the author

Daud
Hey! I'm Daud, Currently Working in IT Company BD. I always like to learn something new and teach others.

Post a Comment

To avoid SPAM, all comments will be moderated before being displayed.
Don't share any personal or sensitive information.