রিভিশন মামলা করার নিয়ম বাংলাদেশ: আদালতের আইনি ত্রুটি সংশোধনের সম্পূর্ণ গাইড
বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় অনেক সময় দেখা যায়, নিম্ন আদালত কোনো মামলার রায় বা আদেশ দিয়েছেন, কিন্তু সেই আদেশে আইনের ভুল প্রয়োগ, ক্ষমতার সীমা লঙ্ঘন বা প্রক্রিয়াগত ত্রুটি রয়েছে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে সব সময় আপিল করার সুযোগ নাও থাকতে পারে। ঠিক এখানেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে রিভিশন মামলা। রিভিশন হলো এমন একটি বিশেষ আইনি ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে উচ্চ আদালত নিম্ন আদালতের কার্যক্রম তদারকি করে আইনি ত্রুটি সংশোধন করতে পারে। এই আর্টিকেলে রিভিশন মামলা করার নিয়ম বাংলাদেশ অনুযায়ী রিভিশনের ধারণা, আপিলের সঙ্গে পার্থক্য, দেওয়ানি ও ফৌজদারি রিভিশন, ধাপে ধাপে আবেদন প্রক্রিয়া, খরচ, সময় এবং বাস্তব কৌশল সহজ ও বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো।
রিভিশন মামলা কী
রিভিশন মামলা হলো— নিম্ন আদালতের কোনো রায়, আদেশ বা কার্যক্রমে আইনি ত্রুটি থাকলে উচ্চ আদালতের কাছে সেই ত্রুটি সংশোধনের আবেদন।
সহজভাবে বললে, রিভিশন মানে হলো— রায় নয়, রায়ের আইনি বৈধতা যাচাই।
রিভিশনের আইনি ভিত্তি
বাংলাদেশে রিভিশন মামলা পরিচালিত হয়—
- দেওয়ানি কার্যবিধি, ১৯০৮ (Section 115)
- ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ (Section 435–439)
- সংবিধানের তত্ত্বাবধায়ক ক্ষমতা (High Court Division)
এই বিধানগুলো অনুযায়ী উচ্চ আদালত নিম্ন আদালতের ওপর নজরদারি করতে পারে।
রিভিশন ও আপিলের মূল পার্থক্য
অনেকেই রিভিশন ও আপিল এক মনে করেন, কিন্তু বাস্তবে এরা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
- আপিল = রায়ের পুনর্বিচার
- রিভিশন = আইনি ত্রুটি যাচাই
আপিলে প্রমাণ পুনর্মূল্যায়ন হয়, কিন্তু রিভিশনে সাধারণত নতুন প্রমাণ গ্রহণ করা হয় না।
কোন ক্ষেত্রে রিভিশন করা যায়
নিম্নলিখিত পরিস্থিতিতে রিভিশন করা যায়—
- আদালত এখতিয়ার ছাড়িয়ে আদেশ দিলে
- আইনের ভুল ব্যাখ্যা বা প্রয়োগ হলে
- প্রক্রিয়াগত গুরুতর ত্রুটি থাকলে
- ন্যায়বিচার ব্যাহত হলে
কোন ক্ষেত্রে রিভিশন করা যায় না
সব আদেশের বিরুদ্ধে রিভিশন করা যায় না—
- যেখানে সরাসরি আপিলের সুযোগ আছে
- ছোটখাটো প্রক্রিয়াগত আদেশ
- চূড়ান্ত রায় যেখানে আপিলযোগ্য
রিভিশন কোন আদালতে করতে হয়
রিভিশনের আদালত নির্ভর করে—
- নিম্ন আদালতের স্তর
- মামলার ধরন
সাধারণত—
- ম্যাজিস্ট্রেট/সহকারী জজ → জেলা জজ
- জেলা জজ → হাইকোর্ট বিভাগ
রিভিশন করার সময়সীমা
রিভিশনের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সাধারণভাবে—
- দেওয়ানি রিভিশন: ৯০ দিনের মধ্যে
- ফৌজদারি রিভিশন: যত দ্রুত সম্ভব
অযথা দেরি করলে রিভিশন খারিজ হতে পারে।
রিভিশন মামলা করার ধাপে ধাপে নিয়ম
- নিম্ন আদালতের আদেশের কপি সংগ্রহ
- আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ
- রিভিশন আবেদন খসড়া প্রস্তুত
- রিভিশন মেমো দাখিল
- কোর্ট ফি প্রদান
- রুল বা নোটিশ জারি
- শুনানি ও যুক্তিতর্ক
- রিভিশন আদেশ
রিভিশন মেমো কী
রিভিশন মেমো হলো রিভিশনের মূল আবেদনপত্র, যেখানে উল্লেখ থাকে—
- কোন আদেশ চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে
- আইনের কোন ভুল হয়েছে
- কেন উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন
দেওয়ানি রিভিশন করার নিয়ম
দেওয়ানি রিভিশনে উচ্চ আদালত দেখে—
- নিম্ন আদালত ক্ষমতার সীমা লঙ্ঘন করেছে কিনা
- আইনের ভুল প্রয়োগ হয়েছে কিনা
এখানে প্রমাণ নয়, আইনই মুখ্য।
ফৌজদারি রিভিশন করার নিয়ম
ফৌজদারি রিভিশনে উচ্চ আদালত—
- সাজার বৈধতা
- প্রক্রিয়ার ন্যায্যতা
যাচাই করে। রাষ্ট্র ও আসামি— দু’পক্ষই রিভিশন করতে পারে।
আরও পড়ুন
রিভিশনে স্টে অর্ডার পাওয়া যাবে?
হ্যাঁ, উপযুক্ত ক্ষেত্রে রিভিশনে স্টে অর্ডার পাওয়া যেতে পারে।
স্টে না থাকলে নিম্ন আদালতের আদেশ কার্যকর হতে পারে।
রিভিশন মামলার খরচ
রিভিশন মামলার খরচ নির্ভর করে—
- আদালতের স্তর
- আইনজীবীর অভিজ্ঞতা
সাধারণত—
- ১৫,০০০ টাকা থেকে শুরু করে
- ৫০,০০০ টাকা বা তার বেশি
রিভিশন নিষ্পত্তিতে কত সময় লাগে
রিভিশন মামলার একটি বড় সুবিধা— আপিলের তুলনায় সময় কম লাগে।
- জেলা পর্যায়: কয়েক মাস
- হাইকোর্ট: ৬ মাস–২ বছর
রিভিশন খারিজ হলে কী হবে
রিভিশন খারিজ হলে—
- নিম্ন আদালতের আদেশ বহাল থাকে
- বিশেষ ক্ষেত্রে আপিল বা রিটের সুযোগ থাকতে পারে
রিভিশন মামলায় সাধারণ ভুল
- আপিলযোগ্য আদেশে রিভিশন করা
- সময় নষ্ট করা
- আইনি ত্রুটি স্পষ্ট না করা
- দুর্বল খসড়া
রিভিশন নিয়ে সাধারণ ভুল ধারণা
- রিভিশন মানেই আপিলের বিকল্প
- নতুন প্রমাণ দেওয়া যাবে
- সব আদেশে রিভিশন হয়
রিভিশন একটি সীমিত কিন্তু শক্তিশালী আইনি অস্ত্র।
উপসংহার
রিভিশন মামলা করার নিয়ম বাংলাদেশ জানা থাকলে নিম্ন আদালতের আইনি ভুলের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিকার পাওয়া সম্ভব। রিভিশন কোনো দ্বিতীয় আপিল নয়— এটি আইনের শুদ্ধতা রক্ষার মাধ্যম। সঠিক ক্ষেত্রে, সঠিক সময় এবং দক্ষ আইনজীবীর মাধ্যমে রিভিশন করলে ন্যায়বিচারের পথ আরও সুগম হয়।
প্রশ্নোত্তর (FAQ)
রিভিশন ও আপিল একসাথে করা যাবে?
না, সাধারণত একটির সুযোগ থাকলে অন্যটি করা যায় না।
রিভিশনে নতুন প্রমাণ দেওয়া যাবে?
না, সাধারণত নতুন প্রমাণ গ্রহণ করা হয় না।
রিভিশনে স্টে অর্ডার কতদিন থাকে?
আদালতের আদেশ অনুযায়ী নির্ধারিত হয়।
রিভিশন খারিজ হলে রিট করা যাবে?
বিশেষ পরিস্থিতিতে রিটের সুযোগ থাকতে পারে।