নাক ডাকার (Snoring) কারণ, লক্ষণ ও সমাধান
নাক ডাকা (Snoring) একটি সাধারণ সমস্যা, যা ঘুমের সময় শ্বাসনালীর বায়ুপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হলে সৃষ্টি হয়। নাক ডাকা অনেকসময় নিরীহ হলেও কখনও এটি ঘুমের মান কমিয়ে দেয় এবং পরবর্তীতে ঘুমবন্ধ (Sleep Apnea)–এর মতো সমস্যা নির্দেশ করতে পারে। নীচে নাক ডাকার কারণ, লক্ষণ ও সমাধান বিস্তারিতভাবে দেওয়া হলো।
নাক ডাকার কারণ
১. গলার পেশি ঢিলে হয়ে যাওয়া
ঘুমের সময় গলার পেশি শিথিল হয়ে গেলে শ্বাসনালীর অংশ সংকুচিত হয়। এতে বাতাস চলাচলে বাধা তৈরি হয় এবং টিস্যু কম্পনের ফলে নাক ডাকার শব্দ হয়।
২. নাক বন্ধ বা সর্দি
সর্দি, সাইনাস সমস্যা বা অ্যালার্জির কারণে নাক বন্ধ থাকলে মানুষ মুখ দিয়ে শ্বাস নিতে বাধ্য হয়; এতে নাক ডাকার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
৩. অতিরিক্ত ওজন
গলার আশেপাশে অতিরিক্ত মেদ জমে শ্বাসনালী সংকুচিত হয়, ফলে নাক ডাকার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
৪. শোয়ার ভঙ্গি (Sleeping Position)
চিৎ হয়ে ঘুমালে জিহ্বা ও গলার নরম টিস্যু পিছনের দিকে পড়ে যেতে পারে এবং বায়ুপ্রবাহ কমে নাক ডাকা বাড়ে।
৫. বয়স
বয়স বাড়ার সাথে সাথে গলা ও নাকের টিস্যু ঢিলে হয়ে যায়, ফলে নাক ডাকার আশংকা বাড়ে।
৬. অ্যালকোহল, ঘুমের ওষুধ বা সেডেটিভ
ঘুমের আগে অ্যালকোহল কিংবা সেডেটিভ গ্রহণ করলে গলার পেশি অতিরিক্ত শিথিল হয় এবং নাক ডাকার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
৭. শ্বাসনালীর গঠনগত সমস্যা
নাকের মধ্যবর্তী পাতটি বাঁকা (Deviated Septum), বড় টনসিল, বড় ইউভুলা বা অন্য কোনো গঠনগত অস্বাভাবিকতা থাকলে সহজেই নাক ডাকা হতে পারে।
৮. ধূমপান
ধূমপান গলার ভিতরের তন্তু ও ঝিল্লিকে ভেজা এবং ফুলে ওঠা করে, ফলে বায়ুপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়ে নাক ডাকা বাড়ে।
নাক ডাকার সমস্যা হলে যেসব লক্ষণ দেখা যায়
ঘুম ভেঙে যাওয়া
বারবার ঘুম ভাঙলে ঘুমের গুণগত মান কমে যায়।
রাতে শ্বাস আটকে যাওয়া
শ্বাসপ্রশ্বাসে বিরতি বা শ্বাস আটকে যাওয়া হলে তা গুরুতর—ঘুমবন্ধ (Sleep Apnea)–এর লক্ষণ হতে পারে।
সকালে মাথাব্যথা
রাতজুড়ে অক্সিজেন কম পাওয়া বা অনিয়মিত শ্বাসের কারণে সকালে মাথাব্যথা হতে পারে।
সারাদিন অবসন্ন লাগা
পর্যাপ্ত বিশ্রাম না পেলে দিনের বেলায় ক্লান্তি ও জাগরণ সমস্যা দেখা দিতে পারে।
মনোযোগ কমে যাওয়া
ঘুমের ব্যাঘাতের ফলে মনোযোগ ও স্মৃতিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
উপরোক্ত লক্ষণগুচ্ছ দেখা গেলে স্লিপ অ্যাপনিয়া বা অন্য গুরুতর সমস্যা থাকতে পারে — এই কারণে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ জরুরি।
আরও পড়ুন:
নাক ডাকার সমাধান (প্রাকৃতিক ও চিকিৎসা)
১. ঘুমানোর ভঙ্গি পরিবর্তন করুন
চিৎ হয়ে নয়, পাশের পাশে বা কাত হয়ে ঘুমানো চেষ্টা করুন। বডি পিলো ব্যবহার করে পাশে শোয়ার অভ্যাস রাখতে সুবিধা হয়।
২. ওজন নিয়ন্ত্রণ করুন
অতিরিক্ত ওজন থাকলে ৫–১০% ওজন কমালেও গলার আশেপাশের চর্বি কমে শ্বাসনালী প্রশস্ত হতে পারে এবং নাক ডাকা কমে যায়।
৩. নাক পরিষ্কার রাখুন
নাক ধোয়ার জন্য স্যালাইন ন্যাসাল স্প্রে বা ন্যাসাল রিন্স ব্যবহার করতে পারেন। সাইনাস বা অ্যালার্জি থাকলে উপযুক্ত চিকিৎসা নিন।
৪. শোবার ঘরের পরিবেশ ঠিক করুন
ঘর ধুলা-মুক্ত রাখুন এবং প্রয়োজন হলে হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করুন। মাথার কিছুটা উচ্চতা দিলে গলাটিস্যু পিছনে পড়া কমে।
৫. অ্যালকোহল, সিগারেট ও সেডেটিভ থেকে বিরত থাকুন
গলার পেশি অতিরিক্ত শিথিল হওয়া থেকে বিরত রাখতে শোবার আগে অ্যালকোহল ও সিডেটিভ গ্রহণ বাদ দিন এবং ধূমপান ত্যাগ করুন।
৬. নিয়মিত ব্যায়াম করুন
শ্বাসযন্ত্র ও গলার পেশি শক্ত রাখতে গলা-ব্যায়াম ও শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম সহায়তা করে।
৭. বিশেষ নাক-ও-মাউথ ডিভাইস
Nasal Strip: বাইরের স্ট্রিপ নাকের গহ্বর খুলে দেয়।
CPAP Machine: Sleep Apnea থাকলে সিজিপ্যাপ (CPAP) মেশিন ধাপে ধাপে বায়ু চাপ দিয়ে শ্বাসনালী খোলা রাখে।
Oral Appliance: ডেন্টাল অ্যাপ্লায়েন্স জিহ্বা বা কপালকে সামান্য সামনে ধরে রাখে, শ্বাসনালী খোলা রাখে।
৮. বড় টনসিল বা গঠনগত সমস্যা থাকলে অস্ত্রোপচার
গঠনগত সমস্যা বা বড় টনসিল থাকলে ডাক্তার পরামর্শে নিচের অপারেশনগুলো করা হতে পারে: Deviated Septum Correction, Tonsillectomy, UPPP (Uvulopalatopharyngoplasty)।
চিকিৎসা বা অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ENT স্পেশালিস্ট বা স্লিপ স্পেশালিস্টের পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষা ও প্রয়োজনীয় টেস্ট (যেমন স্লিপ স্টাডি) করানো জরুরি।
কখন ডাক্তার দেখাবেন?
নিচের অবস্থায় দ্রুত বিশেষজ্ঞ দেখান:
নাক ডাকার সঙ্গে শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া বা শ্বাস আটকে যাওয়া দেখা গেলে; প্রতিদিন সকালে তীব্র মাথাব্যথা থাকলে; দিনের বেলায় অতিরিক্ত ঘুম বা মনোযোগ সমস্যা দেখা দিলে; বা খুব জোরে নাক ডাকার কারণে পরিবারের অন্যদের ঘুম বিঘ্নিত হলে।
এমন ক্ষেত্রে স্লিপ স্পেশালিস্ট বা ENT বিশেষজ্ঞের কাছে দেখান—প্রয়োজনে পলিসোমনোগ্রাফি (স্লিপ স্টাডি) করার পর সঠিক চিকিৎসা নির্ধারিত হবে।
উপসংহার
নাক ডাকার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জীবনধারা পরিবর্তন, ওজন নিয়ন্ত্রণ, নাক পরিচর্যা এবং ঘুমের অভ্যাস বদলে কন্ট্রোল করা সম্ভব। তবে লক্ষণ গুরুতর হলে বা দীর্ঘস্থায়ী হলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করুন।