শিক্ষণীয় গল্প, বাংলা ছোট গল্প, শিশুদের জন্য গল্প, মজার নীতিকথা, গোপাল ভাঁড় গল্প, ঈশপের গল্প, নীতিনির্ভর গল্প, বাচ্চাদের গল্প, বাংলা নীতিশিক্ষার গল্প, ছোটদের গল্প, নৈতিক শিক্ষা, শিশুদের শিক্ষামূলক গল্প, মজার বাংলা গল্প, শিক্ষামূলক গল্প বাংলা, শিক্ষণীয় গল্প বাংলা
এই পোস্টে আমরা এরকমই কিছু সেরা ছোট শিক্ষনীয় মজার গল্প শেয়ার করলাম যা বাচ্চাদের খুব ভালো লাগবে এবং ওদের জন্যে শিক্ষণীয় হবে।
১) লোভী কুকুর
একদিন একটি লোভী কুকুর একটি কসাই-এর দোকানের সামনে ঘুরছিল। হঠাৎ সে দেখতে পেল কসাই দোকানে মাংস কেটে রেখেছে। সেই সুস্বাদু গন্ধে কুকুরটির জিভে জল চলে এলো। লোভ সামলাতে না পেরে সে এক লাফে দোকানে ঢুকে একটি বড় মাংসের টুকরো তুলে নিল এবং দৌড়ে পালিয়ে গেল। কসাই তার পেছনে তাড়া করল, কিন্তু কিছুদূর গিয়ে সে হাল ছেড়ে দিল।
কুকুরটি তখন শহরের বাইরে চলে গিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটি ছোট নদীর ধারে এসে পড়ল। সে মুখে মাংসের টুকরো নিয়ে নদীর ওপারে যেতে একটি সরু সেতুর উপর উঠল। যখন সে সেতু পার হচ্ছিল, তখন হঠাৎ করে নদীর স্বচ্ছ জলের মধ্যে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পেল। তার মনে হলো আরেকটি কুকুর মুখে মাংস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং সেই কুকুরটির মাংস তার চেয়ে বড় ও ভালো। অত লোভে সে নিজের মুখ থেকে মাংস ছেড়ে নদীর জলে ঝাঁপ দিল—প্রতিপক্ষের মাংস ছিনিয়ে নিতে। কিন্তু বাস্তবে সেখানে আর কোনো কুকুর ছিল না। সে তার প্রতিবিম্বের মায়াজালে ভুলে গিয়ে নিজের মাংসের টুকরো হারাল এবং নদীর স্রোতে ভেসে যেতে লাগল।
নীতিকথা: অতিরিক্ত লোভ মানুষের সর্বনাশের কারণ। লোভ এমন এক রোগ যা মানুষকে সর্বস্বান্ত করতে পারে।
২) বুদ্ধিমান কাক
এক চরম গ্রীষ্মের দিনে, একটি কাক খুব তৃষ্ণার্ত হয়ে আকাশে উড়ছিল। তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল, জল না পেলে সে মারা যেতে পারে। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে, সে একটি মাঠের পাশে একটি পুরানো কলসি দেখতে পেল। দৌড়ে গিয়ে সে দেখল কলসিতে সামান্য পরিমাণে জল রয়েছে, কিন্তু জলের স্তর এতটাই নিচে ছিল যে কাক তার ঠোঁট দিয়ে জল ছুঁতে পারল না।
প্রথমে কাকটি হতাশ হল, তারপর তার বুদ্ধি খাটাল। কলসির পাশে কিছু নুড়ি পাথর পড়ে থাকতে দেখে সে একটি একটি করে সেই পাথরগুলি কলসির মধ্যে ফেলতে শুরু করল। প্রতিটি পাথর জলে পড়ার সাথে সাথে জলের স্তর উপরের দিকে উঠতে লাগল। ধীরে ধীরে এত জল উঠে এল যে কাকটি অবশেষে ঠোঁট ডুবিয়ে জল পান করতে পারল। তৃষ্ণা মিটে যাওয়ার পর সে খুশি মনে উড়ে গেল।
নীতিকথা: বুদ্ধি থাকলে উপায় হয়। সমস্যা যত বড়ই হোক না কেন, মাথা ঠান্ডা রেখে চিন্তা করলে তার সমাধান পাওয়া যায়।
৩) শিয়াল ও আঙুর ফল
এক শীতল সকালে, টানা তিন দিন ধরে বৃষ্টি হওয়ার পর একটি শিয়াল প্রচণ্ড খিদেতে কাতর হয়ে পড়ল। বৃষ্টির জন্য সে কোথাও শিকার করতে যায়নি, আর এখন পেট চোঁচো করছে। সে খাবারের খোঁজে বনের মধ্যে ঘুরতে শুরু করল। কিছুদূর যাওয়ার পর তার চোখে পড়ল একটি আঙুর গাছ। সেই গাছে অনেক রসালো ও পাকা আঙুর ঝুলছে। তার খুশির সীমা রইল না।
শিয়ালটি ভাবল, “এই আঙুর খেয়েই আমি পেট ভরাব।” কিন্তু গাছটি ছিল অনেক উঁচু, আর আঙুরের থোকাগুলো ছিল তার নাগালের বাইরে। সে অনেক লাফ দিল, এক পা দিয়ে, দুই পা দিয়ে, কিন্তু কোনওভাবেই থোকা ছুঁতে পারল না। বারবার চেষ্টা করে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে সে ফিরে যেতে লাগল এবং নিজের হীনতা ঢাকার জন্য বলল, “এই আঙুর টক। এমনিতেও খেলে পেট ব্যথা করত।”
নীতিকথা: নিজের অযোগ্যতা ঢাকার জন্য পরনিন্দা করা অনুচিত। বাস্তবে যা অর্জন করতে না পারি, তার জন্য দোষারোপ না করে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়াই শ্রেয়।
Related Posts
৪) রাখাল ছেলে আর নেকড়ে
এক গ্রামের প্রান্তে একটি ছোট রাখাল ছেলে বাস করত। প্রতিদিন তাকে গ্রামের ভেড়াগুলিকে পাহাড়ি চারণভূমিতে নিয়ে যেতে হতো। ছেলেটির এই কাজ একঘেয়ে লাগত। মজা করার উদ্দেশ্যে সে একদিন চিৎকার করে বলল, “নেকড়ে এসেছে! নেকড়ে!” তার চিৎকার শুনে গ্রামবাসীরা দৌড়ে এল নেকড়েকে তাড়াতে। কিন্তু তারা এসে দেখে কিছুই হয়নি। রাখাল ছেলে তাদের দেখে হাসতে লাগল।
পরদিন সে আবার সেই কাজ করল। গ্রামবাসীরা আবারও ছুটে এল, এবং একইভাবে প্রতারিত হয়ে ফিরে গেল। তৃতীয় দিনে, সত্যিই একটি নেকড়ে এসে ভেড়াগুলির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ছেলেটি আতঙ্কে চিৎকার করতে লাগল, “নেকড়ে! নেকড়ে!” কিন্তু এবার আর কেউ বিশ্বাস করল না। কেউ তার ডাকে সাড়া দিল না। ফলে, নেকড়ে তার তিনটি ভেড়া নিয়ে গেল।
নীতিকথা: মিথ্যে গল্প বানানো উচিত নয়। একবার বিশ্বাস হারালে সত্য বললেও কেউ তা বিশ্বাস করে না।
৫) বুদ্ধি খাটিয়ে গণনা
সম্রাট আকবর তার সভায় একদিন অদ্ভুত একটি প্রশ্ন রাখলেন—“এই শহরে ঠিক কতগুলো কাক আছে?” সব সভাসদ হতবাক হয়ে গেল। কেউ কোনো উত্তর দিতে পারছিল না। তখন বীরবল এগিয়ে এলেন এবং হাসিমুখে বললেন, “মহারাজ, শহরে ২১,৫২৩টি কাক আছে।”
আকবর বিস্ময়ভরে জানতে চাইলেন, “তুমি এত নিশ্চিতভাবে এই সংখ্যা বললে কীভাবে?” বীরবল শান্তভাবে উত্তর দিলেন, “আপনি যদি কাক গুনে দেখেন এবং বেশি পান, তাহলে বুঝবেন কিছু কাক আত্মীয়দের সাথে দেখা করতে এসেছে। আর যদি কম পান, তাহলে বুঝবেন কিছু কাক শহরের বাইরে গিয়েছে।” এই উত্তর শুনে সভায় সবাই হেসে উঠল এবং আকবর বীরবলকে তার উপস্থিত বুদ্ধির জন্য পুরস্কৃত করলেন।
নীতিকথা: প্রত্যেক উত্তরের একটি সঠিক ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন। বুদ্ধি আর যুক্তির মাধ্যমে যেকোনো কঠিন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায়।
৬) এক অসৎ বন্ধুর কাহিনি
এক গ্রামে দুই বন্ধুর গভীর বন্ধুত্ব ছিল। তাদের মধ্যে এতটাই বিশ্বাস ছিল যে একজন আরেকজনকে না দেখে থাকতে পারত না। একদিন এক বন্ধু ব্যবসার উদ্দেশ্যে অন্য শহরে গেল এবং তার লোহার সিন্দুকটি বন্ধুর হেফাজতে রেখে গেল। কিছু মাস পর সে ফিরে এসে সিন্দুক ফেরত চাইলে বন্ধু বলল, “তোর সিন্দুক উইপোকা খেয়ে ফেলেছে।” বন্ধুটি কিছু না বলে চলে যায় কিন্তু প্রতিশোধ নেওয়ার পরিকল্পনা করে। একদিন সে তার বন্ধুর ছেলেকে অপহরণ করে। বন্ধু অভিযোগ করলে সে বলে, “তোর ছেলেকে চিল নিয়ে গেছে।” তখন বন্ধুটি তার ভুল বুঝতে পারে এবং ক্ষমা চায়। সে সিন্দুক ফেরত দেয় এবং ছেলেকে ফিরে পায়।
নীতিকথা: মন্দকাজের জন্য ফলভোগ করতেই হবে।
৭) ইঁদুর এবং একটি বিড়ালের গল্প
একটি বাড়িতে অনেক ইঁদুর থাকত যারা মালিকের নানা ক্ষতি করত। বিরক্ত হয়ে মালিক এক বিড়াল আনেন। বিড়াল প্রতিদিন অনেক ইঁদুর মারে। ভয়ে ইঁদুররা গর্তে লুকিয়ে থাকে। তারা বিড়াল থেকে বাঁচার উপায় নিয়ে আলোচনা করতে বসে। এক বৃদ্ধ ইঁদুর প্রস্তাব দেয়, “বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বেঁধে দিলে তার আগমনের শব্দ শোনা যাবে।” সবাই বাহবা দেয়, কিন্তু প্রশ্ন ওঠে—“ঘণ্টা বাঁধবে কে?” এই প্রশ্নের উত্তর দিতে কেউ সাহস করে না।
নীতিকথা: বলা সহজ, করা কঠিন।
৮) সোনার স্পর্শ
এক ধনী ও লোভী মানুষ একদিন একটি পরীর দেখা পেল। পরী তার ইচ্ছা পূরণ করতে বললে, লোকটি চায়, “যা স্পর্শ করব তা–ই যেন সোনায় রূপান্তরিত হয়।” ইচ্ছা পূরণ হয়। সে রাস্তায় পাথর, নুড়ি ছুঁয়ে সোনা বানায়। বাড়ি ফিরে মেয়েকে কোলে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে সোনার মূর্তি হয়ে যায়। লোকটি বুঝতে পারে, তার লোভই তার সর্বনাশের কারণ হয়েছে। তার অনুশোচনার সীমা থাকে না।
নীতিকথা: লোভ, পতনের মূল কারণ।
৯) বিপদ যখন দরজায় ধাক্কা দেয়
এক বাবা তার ছেলেকে তিনটি পাত্রে ডিম, আলু, আর চা পাতা দিয়ে ফুটতে বলেন। দশ মিনিট পর বাবা ছেলেকে বলেন, আলু খোসা ছাড়াতে, ডিম ভাঙতে আর চা ছেঁকে নিতে। ছেলেটি অবাক হয়। বাবা ব্যাখ্যা করেন—তিনটি জিনিস একই পরিস্থিতিতে ছিল, কিন্তু প্রতিক্রিয়া ছিল ভিন্ন। আলু শক্ত থেকে নরম হয়েছে, ডিম নরম থেকে শক্ত, আর চা জলকেই বদলে দিয়েছে। এই গল্প শেখায়, আমাদের প্রতিক্রিয়া আমাদের প্রকৃতি নির্ধারণ করে।
নীতিকথা: কঠিন পরিস্থিতিতে কিভাবে প্রতিক্রিয়া করব, সেটা আমরাই বেছে নিই।
১০) গর্বিত গোলাপ
একটি গোলাপ তার সৌন্দর্য নিয়ে অহংকার করত এবং তার পাশে বেড়ে ওঠা কুৎসিত ক্যাকটাসকে তুচ্ছ ভাবত। গ্রীষ্মে যখন বাগানের কুয়ো শুকিয়ে যায়, গোলাপটি শুকাতে শুরু করে। তখন সে দেখে চড়ুই ক্যাকটাসের থেকে জল পান করছে। গোলাপটি লজ্জিতভাবে ক্যাকটাসের কাছে জল চায়। ক্যাকটাস দয়ালু হয়ে তাকে সাহায্য করে। তখন গোলাপ বোঝে, চেহারার চেয়ে গুণ বেশি মূল্যবান।
নীতিকথা: চেহারা দেখে কাউকে বিচার করা উচিত নয়।
১১) পেনসিলের গল্প
একটি ছোট ছেলে ইংরেজি পরীক্ষায় খারাপ ফল করায় মন খারাপ করে। তখন তার ঠাকুমা তাকে একটি পেনসিল দেন এবং বলেন, “এই পেনসিল থেকেও শেখার আছে।” তিনি বোঝান, ধারালো করার সময় যেভাবে পেনসিল ব্যথা পায়, তেমনি জীবনেও কষ্টের মধ্য দিয়েই মানুষ নিজেকে গড়ে তোলে। পেনসিল যেমন নিজের ভিতর থেকে ভালো বের করে আনে, তেমনই মানুষও নিজের শক্তি দিয়ে এগিয়ে যেতে পারে। আর শেষ পর্যন্ত, সে যেমন একটি চিহ্ন রেখে যায়, তেমনই আমরাও চাইলে পৃথিবীতে নিজের ছাপ রাখতে পারি।
নীতিকথা: ইচ্ছাশক্তি স্বার্থকতা আনে।
১২) লাঠির বান্ডিল
তিন প্রতিবেশী কীটপতঙ্গের কারণে ফসলের সমস্যায় পড়ে। প্রত্যেকে আলাদাভাবে চেষ্টা করে কিন্তু ব্যর্থ হয়। গ্রামের প্রধান তাদের তিনটি লাঠি দেয় এবং একসঙ্গে ভাঙতে বলে। তারা পারে না। তারপর তিনি শেখান, একসঙ্গে কাজ করলে সাফল্য পাওয়া সহজ হয়। তারা ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে কাজ শুরু করে এবং কীটপতঙ্গ তাড়াতে সক্ষম হয়।
নীতিকথা: ঐক্যই বল।
১৩) পিপীলিকা এবং ফড়িং
এক ফড়িং সারাদিন গান গায়, অন্যদিকে পিঁপড়ে পরিশ্রম করে খাবার জমায়। শীত এলে, ফড়িং খাদ্য না পেয়ে কষ্ট পায়। আর পিঁপড়ে সঞ্চিত খাবারে আরামে থাকে। ফড়িং বুঝতে পারে, সময় থাকতে প্রস্তুতি নেওয়া দরকার ছিল।
নীতিকথা: সময় থাকতে কাজ করা উচিত।
১৪) ভাল্লুক এবং দুই বন্ধু
দুই বন্ধু জঙ্গলে হাঁটছিল। হঠাৎ একটি ভাল্লুক এলে একজন গাছে উঠে যায়, অন্যজন শুয়ে পড়ে মরা ভান করে। ভাল্লুক গন্ধ নিয়ে চলে গেলে, গাছে থাকা বন্ধু নেমে জিজ্ঞেস করে, “ভাল্লুক তোমার কানে কী বলল?” সে উত্তর দেয়, “যে বন্ধু বিপদের সময় পাশে থাকে না, তাকে বিশ্বাস কোরো না।”
নীতিকথা: সত্যিকারের বন্ধু বিপদের সময় পাশে থাকে।
১৫) সিংহ ও ইঁদুর
এক সিংহ ঘুমাচ্ছিল, তখন এক ইঁদুর তার নাকে উঠে পড়ে। সিংহ রেগে গিয়ে মেরে ফেলতে চায়, কিন্তু ইঁদুর বলে, “আমাকে ছেড়ে দিন, আমি ভবিষ্যতে আপনাকে সাহায্য করব।” সিংহ হাসে কিন্তু ছেড়ে দেয়। কিছুদিন পরে সিংহ ফাঁদে পড়ে গেলে ইঁদুর এসে তার দড়ি কেটে দেয়। সিংহ বুঝতে পারে, ছোট হলেও কাউকে অবজ্ঞা করা উচিত নয়।
নীতিকথা: ছোটকে অবজ্ঞা কোরো না, উপকার যে কেউ করতে পারে।
উপসংহার
এই নীতিমূলক ছোট ছোট গল্পগুলি শুধু বাচ্চাদের জন্যই নয়, আমাদের সকলের জন্যও শিক্ষণীয়। গল্পগুলির মাধ্যমে আমরা জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পাঠ পেতে পারি। এই ধরনের শিক্ষামূলক গল্প বাচ্চাদের নৈতিকতা, সৃজনশীলতা ও মানসিক বিকাশে দারুণ ভূমিকা রাখে। পড়ার আনন্দের পাশাপাশি তারা জীবনের সত্যিকারের মূল্যবোধ শিখতে পারে।