কেরোসিন তেল কী
কেরোসিন হলো পেট্রোলিয়াম থেকে পরিশোধিত এক ধরনের তরল জ্বালানি, যেটি ডিজেল ও পেট্রলের মাঝামাঝি পরিসরের হাইড্রোকার্বন দিয়ে গঠিত। সাধারণত এর ঘ্রাণ একটু তীব্র হয়, ধোঁয়া তুলনামূলক কম, আর জ্বালানোর জন্য দেশি-বিদেশি চুলা, লণ্ঠন, প্রেশার ল্যাম্পসহ নানান যন্ত্রে ব্যবহার করা যায়। গ্রামাঞ্চল ও দুর্যোগপূর্ণ সময়ে বিদ্যুৎ বা গ্যাস না থাকলে বিশ্বস্ত ব্যাকআপ ফুয়েল হিসেবে কেরোসিন বহুল ব্যবহৃত।
এটি নিত্যজীবনের পাশাপাশি শিল্পক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ—ধাতু পরিষ্কার করা, পেইন্ট থিনার হিসেবে, মাছধরা নৌকায়, এমনকি বিমান জ্বালানির একটি মান (এভিয়েশন কেরোসিন) পর্যন্ত রয়েছে, যদিও সেই মানের জেট ফুয়েল কঠোর স্পেসিফিকেশন মেনে তৈরি হয়।
কেরোসিন কী দিয়ে তৈরি ও কীভাবে প্রস্তুত হয় (উচ্চস্তরের ধারণা)
কেরোসিন ক্রুড অয়েল বা অপরিশোধিত খনিজ তেল থেকে তেল শোধনাগারে প্রস্তুত হয়। সেখানে ভগ্নাংশীয় পাতনের মাধ্যমে বিভিন্ন তাপমাত্রা পরিসরে থাকা উপাদানগুলো আলাদা করা হয়। পেট্রল যে অংশে পাওয়া যায় তার চেয়ে একটু উচ্চ তাপমাত্রা পরিসরে কেরোসিনের ভগ্নাংশ বের হয়, আবার ডিজেল তারও উপরের ভগ্নাংশে থাকে।
শোধনাগারগুলো পরে সেই ভগ্নাংশকে আরও হাইড্রোট্রিটিং ও ফিল্টারিংয়ের মাধ্যমে সালফার, গন্ধ ও অমিশ্রণ কমায়, যাতে জ্বালাতে ধোঁয়া ও ক্ষতিকর নির্গমন কম হয়। মনে রাখতে হবে, এসব প্রক্রিয়া শিল্পমানের নিরাপত্তা, চাপ-তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও পরিবেশ সুরক্ষা মেনে চলে; ঘরে বা অনিয়ন্ত্রিত পরিবেশে কেরোসিন “তৈরি” করা বিপজ্জনক এবং আইনগতভাবেও অনুচিত।
কেরোসিনের মূল বৈশিষ্ট্য
কেরোসিন তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল ও সহজে বহনযোগ্য। এটি অধিকাংশ ধাতব পাত্রে রাখা যায়, তবে প্লাস্টিক বেছে নিতে হয় এমনটি যাতে জ্বালানি-গ্রেডের উপযোগিতা থাকে। কেরোসিনে এনার্জি ডেনসিটি ভালো হওয়ায় ছোট পাত্রে অনেকটা শক্তি মজুত রাখা যায়। পাশাপাশি এর ফ্ল্যাশ পয়েন্ট পেট্রলের তুলনায় বেশি, তাই অগ্নি-ঝুঁকি তুলনামূলক কম হলেও যথাযথ সাবধানতা না নিলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
গন্ধ ও ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণে পরিশোধনের মান গুরুত্বপূর্ণ। বাজারে “নির্মল” বা “লো-সালফার” কেরোসিন পাওয়া গেলে ঘরের ভেতর ব্যবহারে চোখ-নাক জ্বালা ও কালো ধোঁয়া তুলনামূলক কম হয়।
ব্যবহার: ঘরোয়া, কৃষি ও শিল্প
ঘরোয়া ব্যবহার—চুলা, প্রেশার কেরোসিন স্টোভ, হারিকেন/ল্যাম্পে আলো জ্বালানো, উনুনে আগুন ধরানো ইত্যাদি। যেসব এলাকায় গ্যাস লাইনের যোগান নেই বা বিদ্যুতের ঘনঘন সমস্যা, সেখানে কেরোসিন হলো নির্ভরযোগ্য বিকল্প।
কৃষি ও মৎস্য—ছোট নৌযানে ইঞ্জিনের সহায়ক, জাল-দড়ি শুকাতে বা পরিষ্কারে দাগ-তেল চিটচিটে অংশ মুছতে ব্যবহৃত হয়।
শিল্পক্ষেত্র—মেটাল ক্লিনিং, পেইন্ট থিনিং, যন্ত্রাংশ ডিগ্রিজিং, নির্দিষ্ট ধরনের হিটার/ব্লোয়ারে জ্বালানি হিসেবে, এবং মানসম্মত পরিশোধিত রূপে এভিয়েশন টারবাইন ফুয়েলের ভিত্তি ভগ্নাংশ হিসেবে ব্যবহৃত হয় (এভিয়েশনে অবশ্যই কড়া মান নিয়ন্ত্রণ প্রযোজ্য)।
বন্যার সময় কেরোসিনের উপকারিতা
বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের পর যখন বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকে, কেরোসিন হয়ে ওঠে দ্রুত কার্যকর জ্বালানি। হারিকেন বা লণ্ঠনে আলো জ্বালিয়ে আশ্রয়কেন্দ্র, ঘর বা পথচলায় সহায়তা দেয়। কেরোসিন স্টোভে সহজেই রান্না করা যায়, ফলে ত্রাণের শুকনো খাবার ছাড়াও গরম ভাত, ডাল, চা-পাতা সেদ্ধ করা সম্ভব হয়।
বন্যার পানিতে কাঠ ভিজে গেলে আগুন ধরাতে কেরোসিন ফায়ার স্টার্টার হিসেবে কাজে দেয়। তবে খোলা পানির ধার বা নৌকার কাছে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরানো বিপজ্জনক—শুধু নিয়ন্ত্রিত জায়গায়, বাতাসের বিপরীতে দাঁড়িয়ে, সামান্য পরিমাণ ব্যবহার করা উচিত।
এছাড়া ত্রাণ দল ও স্বেচ্ছাসেবীরা ছোট জেনারেটর চালাতে অনেক সময় কেরোসিন-সঙ্গত হিটার বা হট-এয়ার ব্লোয়ার ব্যবহার করে ভেজা কাপড়, কম্বল শুকিয়ে নেয়। সঠিকভাবে সংরক্ষণ করলে কয়েক মাস ধরে স্টক ফুয়েল হিসেবে কেরোসিন স্থিতিশীল থাকে, যা দুর্যোগ-পরবর্তী অনিশ্চয়তায় মানসিক নিরাপত্তাও দেয়।
Related Posts
স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও সংরক্ষণ
ব্যবহারের সময় সতর্কতা
চুলা বা ল্যাম্পে কেরোসিন ঢালার সময় ধূমপান, খোলা আগুন ও স্পার্ক থেকে দূরে থাকুন। ছিটকে গেলে সঙ্গে সঙ্গে শুকনো কাপড় দিয়ে মুছে ফেলুন। শিশুদের নাগালের বাইরে রাখুন এবং কখনোই পানীয় বোতলে কেরোসিন ভরবেন না—ভুল করে পান করার ঝুঁকি থাকে।
ঘরের ভেতরে কেরোসিন জ্বালালে বায়ু চলাচল নিশ্চিত করুন। জানালা-দরজা খানিকটা খোলা রাখুন, না হলে কার্বন মনোক্সাইড জমে মাথাব্যথা, বমি, ঝিমুনি এমনকি গুরুতর বিষক্রিয়া হতে পারে।
সংরক্ষণ ও মেয়াদ
কেরোসিন অন্ধকার, ঠান্ডা জায়গায় ধাতব বা ফুয়েল-গ্রেড প্লাস্টিক ক্যানেতে রাখুন। ঢাকনা সবসময় শক্ত করে বন্ধ রাখুন যাতে বাষ্প বেরোতে না পারে ও বাইরের ধূলা-আর্দ্রতা ঢুকতে না পারে। দীর্ঘদিন রাখা হলে তলানিতে অমিশ্রণ জমতে পারে—ব্যবহারের আগে পরিষ্কার কাপড়ের ফিল্টার দিয়ে ছেঁকে নেওয়া ভালো।
যদি গন্ধ অত্যধিক তীব্র লাগে বা রঙ অস্বাভাবিক মনে হয়, ধরে নিন দূষণ হয়েছে—এমন কেরোসিন আলো/চুলায় না জ্বালিয়েই স্থানীয়ভাবে নিরাপদভাবে নিষ্পত্তি করতে হবে।
বিকল্প ও টেকসই চিন্তা
দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্য ও পরিবেশের স্বার্থে যেখানে সম্ভব এলপিজি, বায়োগ্যাস, ইন্ডাকশন কুকার, সোলার লণ্ঠন ইত্যাদির দিকে ঝোঁকা ভালো। সোলার-চার্জড LED লাইট বন্যার পর আলো জ্বালাতে বিশেষভাবে কার্যকর এবং ধোঁয়া-মুক্ত। তবে জরুরি ব্যাকআপ হিসেবে কেরোসিন স্টক রাখা বাস্তবসম্মত—বিশেষত দুর্গম বা নদীবেষ্টিত এলাকায়।
স্থানীয় দামে বড় পার্থক্য হলে পরিবারভিত্তিক জ্বালানি বাজেটে কেরোসিনের অংশ কমিয়ে ধাপে ধাপে পরিষ্কার জ্বালানির অনুপাত বাড়ানো যেতে পারে। এতে ঘরের বায়ুদূষণ কমে, শিশু ও বয়স্কদের শ্বাসকষ্টের ঝুঁকি হ্রাস পায়।
কেরোসিন তেলের দাম (আগস্ট ২০২৫)
বর্তমানে কেরোসিন তেলের দাম প্রতি লিটার ১১৪ টাকা। এই দাম ২০২৫ সালের ১ জুন থেকে কার্যকর হয়েছে এবং আগস্ট মাস পর্যন্ত অপরিবর্তিত রয়েছে।
সংক্ষেপ
কেরোসিন হলো সহজলভ্য, বহুমুখী ও তুলনামূলক স্থিতিশীল জ্বালানি, যা পেট্রোলিয়াম থেকে শোধনাগারে উচ্চমানের নিরাপত্তা পদ্ধতিতে প্রস্তুত হয়। ঘরোয়া রান্না, আলো, শিল্প ও দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ের জন্য এটি কার্যকর। তবে ব্যবহারে নিরাপত্তা, বায়ুচলাচল, সঠিক সংরক্ষণ ও শিশু-নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। বিকল্প পরিষ্কার জ্বালানির দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হলে স্বাস্থ্য ও পরিবেশ—দুইদিকেই লাভ।