শীতকালে এসি রক্ষণাবেক্ষণের ৮টি সহজ টিপস | এসি সার্ভিসিং | Ac Servicing

শীতকালে এসি বন্ধ রাখলে ধুলা, ফাঙ্গাস ও গ্যাস লিক সমস্যা হতে পারে। জানুন কীভাবে ইনডোর ইউনিট, আউটডোর ইউনিট, কয়েল ও ফিল্টার পরিষ্কার রাখবেন এবং গ্যাস

শীতকালে এসি রক্ষণাবেক্ষণ: কেন গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন?

গরমকালে এসি দিনের পর দিন চললে শীতে একেবারেই বন্ধ করে রাখাই স্বাভাবিক মনে হয়। কিন্তু দীর্ঘদিন অকেজো রেখে দিলে এসির ভিতর ধুলা জমে, আর্দ্রতা থেকে ফাঙ্গাস জন্মাতে পারে এবং রেফ্রিজারেন্ট গ্যাসের চাপ কমে গিয়ে পরের গরমে সমস্যা তৈরি করতে পারে। তাই শীতকালের আগে ও শীতের মধ্যে কিছু সহজ ও নিয়মিত যত্ন নিলে এসির কর্মদক্ষতা ভাল থাকবে, সার্ভিসিং কম লাগবে এবং আয়ু বাড়বে। নিচে ধাপে ধাপে কী করতে হবে তা বিস্তারিতভাবে দেখানো হলো।

Ac

১. ইনডোর ইউনিট নিয়মিত পরিষ্কার করুন

শীতকালে ঘর বেশি সময় বন্ধ রাখলে ইনডোর ইউনিটে ধুলাবালি জমে যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। ইনডোর ইউনিটের ফিল্টার নিয়মিত খুলে পরিষ্কার করা সবচেয়ে সহজ ও কার্যকর পদ্ধতি। ফিল্টারকে পরিষ্কার পানিতে বা হালকা সাবান মিশিয়ে ধুয়ে দিন, সম্পূর্ণ শুকোতে দিন এবং পরে আবার সেট করুন। যদি ফিল্টার অত্যন্ত নোংরা হয় বা টাকে ভেঙে গেছে, তা বদলিয়ে নিন। পরিষ্কার ফিল্টার হলে এয়ারফ্লো ঠিক থাকে, কম্প্রেসরে অতিরিক্ত চাপ পড়ে না এবং পরের মরসুমে এসি দ্রুত ঠান্ডা করে কম বিদ্যুৎ খরচ করে।

পরামর্শ: প্রতি ১০–১৫ দিনে অন্তত একবার ফিল্টার ধুয়ে রাখুন; যদি ঘরের পরিবেশ বেশি ধুলোময় বা পোষা প্রাণী থাকে তাহলে ফ্রিকোয়েন্সি বাড়ান।

২. আউটডোর ইউনিট চেক করুন ও পরিষ্কার রাখুন

আউটডোর ইউনিট বাইরে থাকা কারণে সেখানে পাতা, ধুলা, কুঁড়েঘর ইত্যাদি জমে যেতে পারে যা হিট এক্সচেঞ্জ প্রক্রিয়া বাধা দেয়। আউটডোর ইউনিটের ব্যাক কভার খুলে নরম ব্রাশ বা ব্লোয়ার দিয়ে ধুলো-ময়লা উঠিয়ে ফেলুন। ইউনিটের সামনের অংশে কোনো বাধা থাকলে সেটিও সরিয়ে ফেলুন যাতে বায়ু সহজে চলাচল করতে পারে। শীতকালে যদি দীর্ঘদিন বন্ধ রাখার পরিকল্পনা থাকে তবে বা বরফ-পানি থেকে রক্ষা করার জন্য উপযুক্ত কাভার দিয়ে রাখুন—কিন্তু কাভার এমন হওয়া উচিত যে আর্দ্রতা আটকাবে না (অনূর্ধ্বায়ন: সম্পূর্ণ সিল করে রাখবেন না)।

নিরাপত্তা টিপস: আউটডোর ইউনিটের চারপাশে ইঁদুর বা পোকামাকড় আশ্রয় নিতে পারে; মাঝে মাঝে দেখে নিন যাতে ওয়্যার বা পাইপ কাটা না থাকে। বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রেখে পরিষ্কার কাজ করুন অথবা পেশাদারকে ডেকে করান।

৩. কনডেনসার ও ইভাপোরেটর কয়েল পরিষ্কার রাখুন

কয়েল (কনডেনসার ও ইভাপোরেটর) যদি ময়লা ও ধুলোতে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে, কুলিং দক্ষতা কমে যায় এবং কম্প্রেসরে বেশি কাজ পড়ে। কয়েল ক্লিনার স্প্রে ব্যবহার করে অবশ্যই নির্দেশনা মেনে পরিষ্কার করুন; যদি আপনার হাতে উপযুক্ত ক্লিনার না থাকে বা কয়েল খুবভাবে ময়লায়িত হয়ে থাকে তাহলে পেশাদার টেকনিশিয়ানের সাহায্য নিন। পরিষ্কার কয়েল কুলিং ক্ষমতা ২০–৩০% পর্যন্ত বাড়াতে পারে এবং কম্প্রেসরের ওপর চাপ উল্লেখযোগ্যভাবে কমায়।

কোয়েল রক্ষণাবেক্ষণের টিপস: কয়েল পরিষ্কারের পরে এগুলো ঠিকমত শুকোনো আছে কি না নিশ্চিত করুন—আর্দ্র অবস্থায় ঢালাই বা চালু করলে ফাঙ্গাস বৃদ্ধি পেতে পারে।

৪. গ্যাস লিক ও প্রেসার পরীক্ষা করুন

শীতকালে কয়েক মাস এসি বন্ধ রাখলে রেফ্রিজারেন্ট গ্যাসের চাপ কমে যেতে পারে অথবা ছোটখাট লিক ধরা নাও পড়তে পারে। গ্যাস কম থাকলে এসি পর্যাপ্ত শীতল করবে না, বরং বিদ্যুৎ বেশি খরচ করবে এবং কম্প্রেসরের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়বে। তাই শীতকালের আগে বা শীতকালে গ্যাস প্রেসার ও লিক টেস্ট করিয়ে নিন। যদি কোনো লিক পাওয়া যায় তা দ্রুত মেরামত করান ও সঠিক পরিমাণ রেফ্রিজারেন্ট ভরিয়ে নিন।

মনে রাখবেন: রেফ্রিজারেন্ট সংক্রান্ত কাজ নিরাপত্তার দিক থেকে পেশাদারের দ্বারা করানোই উত্তম—পর্যাপ্ত সতর্কতা ও সঠিক ভ্যাকুয়ামিং/চেক করার পরেই কাজ শেষ করুন।

৫. সার্কিট ব্রেকার ও রিমোট কন্ট্রোল পরীক্ষা করুন

শীতকালে এসি পুরোপুরি বন্ধ রাখলে রিমোট কন্ট্রোলের ব্যাটারি দুর্বল হয়ে যেতে পারে এবং সার্কিট ব্রেকারেও সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। রিমোটের ব্যাটারিটা আগেই পরিবর্তন করে রাখুন যাতে পরের মরসুমে ঝটপট চালু করা যায়। এসি চালুর সময় যদি অস্বাভাবিক শব্দ, অন-কয়েল নইলে চাপা শব্দ বা অনিয়মিত ব্রেকার ট্রিপ লক্ষ্য করেন তাহলে টেকনিশিয়ান ডেকে দেখে নিন—অনেক সমস্যা ছোট থেকেই শুরু হয়।

চেকলিস্ট: রিমোট ব্যাটারি, পাওয়ার কর্ডের অবস্থা, পলিসোল বা সার্কিট ব্রেকারের ফিউস/ট্রিপ নিয়মিত পরীক্ষা করুন।

৬. আর্দ্রতা ও ফাঙ্গাস নিয়ন্ত্রণ

দীর্ঘদিন বন্ধ রাখলে এসির ভেতরে আর্দ্রতা জমে ফাঙ্গাস বা খারাপ গন্ধ হতে পারে। এই সমস্যা এড়াতে সপ্তাহে অন্তত একবার এসি ফ্যান মোডে ২০–৩০ মিনিট চালান—এতে ভিতরে জমে থাকা আর্দ্রতা ফ্যানের মাধ্যমে বের হয়ে যায় এবং গন্ধ রোধ হয়। যদি ঘরে সাধারণত আর্দ্রতা বেশি থাকে, তাহলে ডিহিউমিডিফায়ার ব্যবহার করুন বা ঘরটি মাঝে মাঝে ভেন্টিলেট করুন।

অনুশীলন: গরম মৌসুমে এসি চালানোর আগে ফ্যান মোডে চালিয়ে ভিতরের আর্দ্রতা ও গন্ধ নিয়ন্ত্রণে রাখুন—এটি সহজ একটি অভ্যাস কিন্তু পরবর্তীতে বড় সেবা বাঁচায়।

৭. স্ট্যান্ডবাই মোডে মাসিক পরীক্ষাসব

শীতকালে মাসে অন্তত একবার এসি ৫–১০ মিনিট স্ট্যান্ডবাই বা চালু করে পরীক্ষা করে নিন। এতে রেফ্রিজারেন্ট সিস্টেম সচল থাকে, কম্প্রেসরের সিল ও মোটর শুকিয়ে যায় না এবং সার্কিট ঠিকমত কাজ করছে কি না বোঝা যায়। অনেক সময় দীর্ঘদিন পরে চালালে কম্প্রেসর স্টার্ট নিতে সমস্যা করে—আগেভাগে পরীক্ষা করলে অপ্রত্যাশিত সমস্যার ঝামেলা কমে।

কার্যকারিতা: নিয়মিত এই সংক্ষিপ্ত চালনা সার্ভিসিংয়ের প্রয়োজনীয়তা কমায় এবং বড় যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়ার সম্ভাবনা কমায়।

৮. শীতকালে প্রফেশনাল সার্ভিস করান

শীত কালে সার্ভিস করানো সুবিধাজনক কারণ তখন সার্ভিসিংয়ের চাপ কম থাকে—টেকনিশিয়ান সহজে সময় দিতে পারেন এবং সার্ভিসও ভালো করে হয়। ওয়াশিং, ফিল্টার পরিষ্কার, কয়েল ক্লিনিং, গ্যাস প্রেসার পরীক্ষা সহ পুরো সিস্টেম পরিক্ষা করিয়ে নিন। প্রতি বছর কমপক্ষে ১–২ বার পেশাদার সার্ভিস করালে এসির আয়ু বাড়ে এবং পরবর্তী গরম মৌসুমে অপ্রত্যাশিত সমস্যার ঝুঁকি কমে।

সেবার সময় লক্ষ্য রাখুন: সার্ভিসের সময় যেসব কাজ করা হয়েছে তার এক বিবরণ লিখে রাখুন—যদি কোনো অংশ বদলানো বা বেশি নজরদারির প্রয়োজন পরে, আপনি সহজেই তা দেখতে পারবেন।

তথ্যসমৃদ্ধ সংক্ষিপ্ত চেকলিস্ট

শীতকালের আগে বা শীতকালে করনীয়:

  1. ইনডোর ফিল্টার খুলে ধোয়া/পরিষ্কার করা (১০–১৫ দিনে একবার)।
  2. আউটডোর ইউনিটের ধুলো ও পাতা পরিষ্কার করা ও কাভার করা (যথাযথভাবে)।
  3. কয়েল ক্লিনিং ও শুকানো।
  4. গ্যাস লিক ও প্রেসার পরীক্ষা করানো।
  5. রিমোট ব্যাটারি ও সার্কিট ব্রেকার চেক করা।
  6. সপ্তাহে একবার ফ্যান মোডে ২০–৩০ মিনিট চালানো।
  7. মাসে একবার স্ট্যান্ডবাই/শর্ট টেস্ট করা।
  8. বছরে ১–২ বার পেশাদার সার্ভিস করানো।

সাধারণ ভুল এবং সতর্কতা

অনেকে শীতকালে এসি সম্পূর্ণ ঢেকে রাখেন বা ভেজা অবস্থায় রাখা থাকে—এটি বন্দী আর্দ্রতা তৈরি করতে পারে এবং ফাঙ্গাস জন্মাতে সাহায্য করে। বাইরে থাকা ইউনিটে প্লাস্টিক টাইট কভার ব্যবহার করলে ভেতরে ছেঁচিয়ে থাকা আর্দ্রতা বাতাসে আটকে থেকে ক্ষতি করতে পারে; বরং হালকা, বায়ুচলাচল থাকা কাভার ব্যবহার করুন। এছাড়া রেফ্রিজারেন্ট সংক্রান্ত কাজ নিজেরাই না করে পেশাদারের সাহায্য নেবেন—ভুল মেরামত এসি-কে বড় ক্ষতির মুখে ফেলতে পারে।

সংক্ষিপ্ত উপসংহার

শীতকালে এসি সম্পূর্ণ বন্ধ করে রাখলেই সেটি নিরাপদ থাকবে—এমন ধারণা ভুল। নিয়মিত ও সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ করলে এসির পারফরম্যান্স উন্নত থাকবে, বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে এবং জীবদ্দশা বাড়বে। উপরের সহজ ধাপগুলো মেনে চললে পরের গরমে এসি চালু করলেই দ্রুত এবং স্বচ্ছন্দে ঠান্ডা পরিবেশ পাবেন।

দ্রুত রেফারেন্স: ইনডোর ফিল্টার পরিষ্কার, আউটডোর ইউনিট চেক, কয়েল ক্লিন, গ্যাস প্রেসার পরীক্ষা, রিমোট ও সার্কিট চেক, ফ্যান মোডে নিয়মিত চালনা, মাসিক স্ট্যান্ডবাই টেস্ট ও বছরে ১–২ বার পেশাদার সার্ভিস—এইগুলো মেনে চললেই এসি স্বাস্থ্যবান থাকবে।

About the author

Leo
Hey! I'm Leo. I'm always eager to learn new things and enjoy sharing my knowledge with others.

Post a Comment

To avoid SPAM, all comments will be moderated before being displayed.
Don't share any personal or sensitive information.