আজকের আধুনিক যুগে স্মার্টফোন আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে রাতে ঘুমানোর আগে পর্যন্ত—সবক্ষেত্রেই এই ছোট ডিভাইসটি আমাদের হাতছাড়া হয় না। যোগাযোগ, কাজ, বিনোদন, পড়াশোনা, এমনকি কেনাকাটাও এখন স্মার্টফোন ছাড়া কল্পনা করা যায় না।
তবে একদিকে যেমন স্মার্টফোন আমাদের জীবনকে সহজ করেছে, অন্যদিকে এটি আমাদের ওপর নির্ভরশীলতাও বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই ফোন নষ্ট হয়ে গেলে বা কোনো সমস্যায় পড়লে আমরা যেন একপ্রকার দিশেহারা হয়ে যাই। অনেকেই মনে করেন, আধুনিক ফোনগুলো যেহেতু ওয়াটারপ্রুফ বা ওয়াটার রেজিস্ট্যান্ট, তাই এগুলো খুব টেকসই। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যত উন্নত প্রযুক্তিই ব্যবহার করা হোক না কেন, একটু অবহেলা বা ভুল ব্যবহারেই আপনার প্রিয় স্মার্টফোন অচল হয়ে যেতে পারে।
আজকের আলোচনায় আমরা বিস্তারিত জানব, কী কী কারণে আপনার স্মার্টফোন দ্রুত নষ্ট হয়ে যেতে পারে এবং কিভাবে সহজ কিছু নিয়ম মেনে ফোনকে দীর্ঘদিন ভালো রাখা সম্ভব। চলুন তাহলে জেনে নিই স্মার্টফোনের যত্ন নেওয়ার কার্যকর উপায় ও নষ্ট হওয়ার সাধারণ কারণগুলো।
যখন তখন বৃষ্টিতে পড়তে হচ্ছে। প্রস্তুতি না থাকায় সঙ্গে থাকা স্মার্টফোন ভিজে নষ্ট হচ্ছে। যদিও ফোন কোম্পানি থেকে বলাই থাকে ফোন ওয়াটারপ্রুফ। এমনকি এখন বেশিরভাগ ফোনেই ওয়াটার রেজিসট্যান্ট রেটিং দেওয়া থাকে। তারপরও দেখা যায় শেষ রক্ষা হয় না।
তবে শুধু পানি ঢুকলেই যে ফোন নষ্ট হয়, এমন না। ফোন আরও অনেক কারণে নষ্ট হতে পারে। নিচে স্মার্টফোন নষ্ট হওয়ার কিছু সাধারণ কারণ ও তা থেকে বাঁচার উপায় নিয়ে আলোচনা করা হলো।
অতিরিক্ত চার্জ করা
ফোন একেবারে ০ শতাংশে এনে চার্জ করা যেমন ক্ষতিকর, তেমনি সারাক্ষণ ফোন চার্জে দিয়ে রাখাও ভালো নয়। ব্যাটারি অতিরিক্ত চার্জ পেলে তা দ্রুত ক্ষয় হতে শুরু করে এবং দীর্ঘমেয়াদে ব্যাটারির আয়ু কমে যায়। অনেকেই আবার নকল বা সস্তা চার্জার ব্যবহার করেন, যা ব্যাটারি ও সার্কিট উভয়ের জন্য বিপদজনক। নকল চার্জার থেকে অতিরিক্ত ভোল্টেজ বা কম ভোল্টেজ পাওয়া যেতে পারে, যা ব্যাটারির পারফরম্যান্সে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। তাই সবসময় অরিজিনাল চার্জার ব্যবহার করাই সবচেয়ে নিরাপদ উপায়।
অতিরিক্ত ঠান্ডা বা গরম পরিবেশ
অতিরিক্ত ঠান্ডা বা গরম কোনো অবস্থাতেই স্মার্টফোন ভালোভাবে কাজ করতে পারে না। গরম আবহাওয়ায় ফোন অতিরিক্ত গরম হয়ে অভ্যন্তরীণ হার্ডওয়্যার যেমন প্রসেসর, ব্যাটারি, বা মাদারবোর্ডের ক্ষতি করতে পারে। রোদে বা গরম গাড়ির ভেতরে ফোন রেখে দিলে এর অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা দ্রুত বেড়ে যায়, যার ফলে ব্যাটারি ফুলে যাওয়া বা বিস্ফোরণ পর্যন্ত ঘটতে পারে। অন্যদিকে, ঠান্ডা আবহাওয়ায় ব্যাটারির কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়, ডিসপ্লে ধীরে কাজ করে, এবং টাচ সেন্সরও সাড়া দিতে দেরি করে। তাই চরম আবহাওয়া থেকে ফোন দূরে রাখা জরুরি।
ধুলাবালি ও অপরিষ্কার চার্জিং পোর্ট
ফোনের চার্জিং পোর্ট ও হেডফোন জ্যাক সবসময় পরিষ্কার রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় পকেট বা ব্যাগে ধুলাবালি জমে এই অংশে ঢুকে যায়, ফলে চার্জ ঠিকভাবে নেয় না বা অডিও সংযোগে সমস্যা দেখা দেয়। কিছু ক্ষেত্রে চার্জিং পোর্টে ধুলা জমে সার্কিট শর্ট হয়ে ফোন পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই নিয়মিত নরম ব্রাশ বা কটন স্টিক দিয়ে পোর্ট পরিষ্কার করা উচিত, তবে সতর্কতার সঙ্গে যেন কোনো তরল পদার্থ ব্যবহার না হয়।
সফটওয়্যার আপডেট না করা বা ভুল অ্যাপ ব্যবহার
অনেক ব্যবহারকারী সফটওয়্যার আপডেট উপেক্ষা করেন, যা ফোনের পারফরম্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পুরোনো অপারেটিং সিস্টেমে নিরাপত্তা ত্রুটি থাকতে পারে, যা হ্যাকারদের জন্য সুযোগ তৈরি করে। আবার অজানা সোর্স থেকে অ্যাপ ইনস্টল করলে ফোন ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। ফলে ফোন হ্যাং করে, ডেটা হারিয়ে যায় বা পারফরম্যান্স নষ্ট হয়। তাই নিয়মিত অফিসিয়াল আপডেট ইনস্টল করা এবং কেবল নির্ভরযোগ্য সোর্স থেকে অ্যাপ ব্যবহার করা উচিত।
আরও পড়ুনঃ
ফোন বারবার পড়ে যাওয়া বা শক খাওয়া
ফোন পড়ে যাওয়া আমরা প্রায়ই হালকাভাবে নেই, কিন্তু প্রতিবার পড়ে যাওয়ার পর অভ্যন্তরীণ ক্ষতি হতে পারে। ফোনের ডিসপ্লে, ক্যামেরা সেন্সর বা মাদারবোর্ডে অদৃশ্য চিড় ধরতে পারে, যা সময়ের সঙ্গে বড় সমস্যায় রূপ নেয়। এমনকি ফোন চালু থাকলেও এর ভেতরের সংযোগ দুর্বল হয়ে যেতে পারে, ফলে হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া বা কাজ না করার মতো সমস্যা দেখা দেয়। তাই সবসময় ফোনে ভালো মানের কভার ও স্ক্রিন প্রটেক্টর ব্যবহার করা জরুরি।
কম মানের ব্যাটারি বা পার্টস প্রতিস্থাপন
লোকাল মার্কেট থেকে সস্তায় ব্যাটারি বা পার্টস প্রতিস্থাপন করলে তা ফোনের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। অরিজিনাল না হলে এসব পার্টস সঠিক ভোল্টেজ সরবরাহ করতে পারে না, যার ফলে ফোন অতিরিক্ত গরম হয় বা সার্কিট শর্ট হতে পারে। অনেক সময় এর ফলে বিস্ফোরণ বা আগুন লাগার ঘটনাও ঘটে। তাই ফোন সার্ভিসিংয়ের সময় শুধুমাত্র অথরাইজড সার্ভিস সেন্টার বা ব্র্যান্ড অনুমোদিত পার্টস ব্যবহার করা উচিত।
অতিরিক্ত অ্যাপ ও স্টোরেজ ফুল থাকা
স্মার্টফোনে যখন স্টোরেজ প্রায় পূর্ণ থাকে, তখন ফোনের কার্যক্ষমতা অনেক হ্রাস পায়। ব্যাকগ্রাউন্ডে একাধিক অ্যাপ একসাথে কাজ করলে প্রসেসর ও র্যামের উপর বাড়তি চাপ পড়ে। এর ফলে ফোন ধীরগতির হয়, হ্যাং করে বা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি ব্যাটারিও দ্রুত শেষ হয়ে যায়। তাই নিয়মিত অপ্রয়োজনীয় ফাইল ও অ্যাপ মুছে ফেলা উচিত, যাতে ফোনের গতি বজায় থাকে এবং পারফরম্যান্স ভালো থাকে।
স্মার্টফোন দীর্ঘদিন ভালো রাখতে যা করবেন
- সবসময় অরিজিনাল চার্জার ব্যবহার করুন।
- রোদ বা অতিরিক্ত গরম/ঠান্ডা জায়গায় ফোন রাখবেন না।
- সপ্তাহে অন্তত একবার ফোন রিস্টার্ট দিন এবং অপ্রয়োজনীয় অ্যাপ ডিলিট করুন।
- ফোনে কভার ও স্ক্রিন প্রটেক্টর ব্যবহার করুন।
- নিয়মিত সফটওয়্যার আপডেট দিন।
- ফোন পরিষ্কার রাখুন এবং পানি থেকে দূরে রাখুন।
শেষ কথা: স্মার্টফোন আমাদের প্রতিদিনের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই এটি ভালো রাখতে সামান্য যত্নই যথেষ্ট। সঠিক ব্যবহার ও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ আপনার ফোনের আয়ু কয়েক বছর বাড়িয়ে দিতে পারে।