বাংলাদেশি বাণিজ্যিক সিনেমায় যখন একঘেয়ে গল্প আর একই ফর্মুলা বারবার ব্যবহার হয়ে আসছে, তখন হঠাৎ করেই এসে হাজির হয় ‘ইনসাফ’। এটি শুধু একটি সিনেমা নয়, বরং একটি প্রচেষ্টা—একটা সাহসী পদক্ষেপ যা একদিকে যেমন সম্ভাবনার কথা বলে, অন্যদিকে সীমাবদ্ধতার প্রতিচ্ছবিও দেখায়। পরিচালক সঞ্জয় সমাদ্দার এর আগে ওপার বাংলায় কাজ করলেও, বাংলাদেশের মূলধারার সিনেমায় এটি তাঁর প্রথম দৃষ্টান্ত। আর এই দৃষ্টান্ত কতটা শক্তিশালী ছিল, সেটাই আজকের এই আলোচনা।
সিনেমার প্রেক্ষাপট ও গল্পের ধারণা
এক গ্যাংস্টারের গল্পে জাস্টিসের খোঁজ
‘ইনসাফ’-এর গল্প আবর্তিত হয়েছে ঢাকার এক সময়ের কুখ্যাত গ্যাংস্টার ইউসুফকে কেন্দ্র করে—যার মৃত্যু আগেই ঘটেছে বলে শোনা যায়, কিন্তু শহরের নানা প্রান্তে তার ছায়া এখনো ঘোরাফেরা করে। এখান থেকেই শুরু হয় রহস্য, উদ্বেগ আর উত্তেজনার এক নতুন ধারা। দায়িত্ব পড়ে এএসপি জাহান নামের এক সৎ পুলিশ অফিসারের উপর, যে ধীরে ধীরে খোলাসা করতে থাকে ইউসুফ নামক কিংবদন্তি অপরাধীর অতীত আর বর্তমানের গল্প।
এই গল্পে প্রেম আছে, প্রতিশোধ আছে, দুর্নীতি আর রাজনীতির ঘূর্ণিপাকে জড়ানো বাস্তবতা আছে। একদিকে যেমন থ্রিলার ও গ্যাংস্টার ফ্লেভার রয়েছে, অন্যদিকে রয়েছে
‘মানুষ’ থেকে ‘ইনসাফ’: দুই বাংলার সংযোগ
সঞ্জয় সমাদ্দার যখন ‘মানুষ’ নির্মাণ করেছিলেন ওপার বাংলায় জিতের সাথে, তখনই বোঝা গিয়েছিলো তিনি শুধু বিনোদন নয়, বরং মানবিক গল্প বলার মধ্যে দিয়ে একটি আলাদা পরিচয় গড়তে চান। সেই একই ধারা ‘ইনসাফ’-এও দেখা গেছে। তবে পার্থক্য হলো, ‘ইনসাফ’ পুরোপুরি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নির্মিত। এখানেও পরিচালক দেখিয়েছেন দুর্নীতির বাস্তবতা, সমাজের গা-চাপা দেওয়া সত্য আর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভেতরের জটিলতা।
এই সিনেমায় সঞ্জয় যেমন অ্যাকশন দৃশ্য ভালোভাবে সাজিয়েছেন, তেমনি দিয়েছেন চরিত্রগুলোর ভেতরকার আবেগ প্রকাশের সুযোগ। বিশেষ করে দ্বিতীয়ার্ধে যখন গল্প গভীর হয়, তখন অনুভব করা যায় পরিচালক এই সিনেমাকে শুধু একটি বিনোদনের খোরাক নয়, বরং একটি স্টেটমেন্ট হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছেন।
 
শরীফুল রাজ: ট্রান্সফরমেশন ও অভিনয়
‘ইনসাফ’ সিনেমার সবচেয়ে আলোচিত এবং সম্ভবত সবচেয়ে সফল দিক হলো শরীফুল রাজের ট্রান্সফরমেশন। এই সিনেমায় তাকে দেখা গেছে একাধিক লুকে—কখনো হালকা দাড়ি-চশমা পরা, আবার কখনো রাফ-অ্যান্ড-টাফ গ্যাংস্টার রূপে। তাঁর শারীরিক প্রস্তুতি, ফাইট সিক্যুয়েন্সে ডেডিকেশন এবং অভিনয়ের গভীরতা সত্যিই প্রশংসনীয়।
রাজের চরিত্রটি বেশ জটিল। তিনি কেবল একজন গ্যাংস্টার নন, বরং একজন মানুষ, যার অতীত ও বর্তমানের দ্বন্দ্বে সে নিজেই বারবার কেঁপে উঠেছে। এই দ্বন্দ্বকে রাজ তাঁর অভিব্যক্তি ও সংলাপে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তার প্রতিটি দৃশ্যে যেন কিছু বলার ছিলো। দর্শককে ধরে রাখার মতো একটা ব্যক্তিত্ব তিনি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন।
তাসনিয়া ফারিণ: প্রথম বাণিজ্যিক সিনেমায় আত্মপ্রকাশ
তাসনিয়া ফারিণের জন্য ‘ইনসাফ’ ছিলো একধরনের পরীক্ষার মঞ্চ। কারণ এটি তার প্রথম বাণিজ্যিক সিনেমা, যেখানে তাকে অ্যাকশন এবং রোমান্স দুই ভূমিকাতেই দেখা গেছে। ফারিণের এন্ট্রি সিক্যুয়েন্সটি ছিলো একেবারে থ্রিলিং এবং শুরুর সেই দুইটি ফাইট সিক্যুয়েন্স দর্শককে বেশ আনন্দ দেয়।
তার চরিত্রে ছিলো গুরুত্ব এবং সংবেদনশীলতা—যা একজন অভিনেত্রীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। ফারিণ এই দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করেছেন, যদিও কিছু জায়গায় এক্সপ্রেশন আরও উন্নত হতে পারতো। তবে আত্মবিশ্বাসের সাথে স্ক্রিন কভারেজ এবং সংলাপ ডেলিভারির দিক থেকে তিনি সফল। যদি তিনি এমন ভূমিকায় নিয়মিত কাজ করেন, তাহলে বাংলাদেশের কমার্শিয়াল সিনেমায় নারীদের নতুন ধারা যোগ হতে পারে।
সহ অভিনেতা ও ক্যামিও রোলের প্রভাব
মোশাররফ করিমের স্ক্রিনটাইম কম হলেও তার অভিনয় সবসময়ই নির্ভরযোগ্য। আলগা দাঁড়ি নিয়ে যতটা সমালোচনা হয়েছে, পর্দায় তার এতটা প্রভাব পড়েনি। মিশা সওদাগর ছিলেন নিজের জায়গায়, তবে চমকপ্রদ কিছু ছিলো না। ফজলুর রহমান বাবুও ছিলেন বরাবরের মতোই স্থির, নির্ভরযোগ্য।
তবে এই সিনেমার সবচেয়ে চমকপ্রদ দিক হলো একটি বিশেষ ক্যামিও রোল, যেটি গল্পে নতুন মাত্রা যোগ করেছে এবং দর্শকদের মনে রেখাপাত করেছে। যদিও এখানে তার নাম উল্লেখ করছি না, কারণ স্পয়লার মুক্ত রাখতে চাই। কিন্তু দর্শক যখন দেখবেন, তখন সেটি অবশ্যই তাদের মুগ্ধ করবে।
চিত্রনাট্য ও স্ক্রিনপ্লে বিশ্লেষণ
প্রথমার্ধ বনাম দ্বিতীয়ার্ধ: কোথায় ভারসাম্য?
‘ইনসাফ’-এর স্ক্রিনপ্লে একদিকে ধীর, অন্যদিকে ঘটনাবহুল। প্রথমার্ধে খুব বেশি কিছু ঘটছে না এমন মনে হলেও, আসলে সেখানে চরিত্র বিল্ডআপ এবং রহস্যের বীজ বপন করা হয়েছে। কিছু কিছু মুহূর্তে সিনেমার গতি ধীর মনে হতে পারে, কিন্তু বিরতির আগের শকিং সিক্যুয়েন্স দর্শককে নতুন উদ্দীপনায় এনে ফেলে।
দ্বিতীয়ার্ধে এসে সিনেমাটি আরও সংলগ্ন ও গভীর হয়ে ওঠে। আবেগ তৈরি করা হয় ধীরে ধীরে, বিশেষ করে প্রধান চরিত্রদের ভেতরের দ্বন্দ্ব প্রকাশের ক্ষেত্রে। তবে সমস্যা হলো, ক্লাইমেক্সে এসে কিছুটা তাড়াহুড়া দেখা গেছে। একটি নাটকীয় মুহূর্তকে যথাযথ সময় না দিয়ে খুব দ্রুত সমাপ্তি টানার চেষ্টা করা হয়েছে বলে মনে হয়।
৬. ভিজ্যুয়াল আরটিও এবং প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণ
‘ইনসাফ’-এ প্রচেষ্টা দেখা গেছে দৃশ্যের শৈলী, রঙ ও কাঠামোতে। সিনেমাটোগ্রাফি এবং কালার গ্রেডিং মূলত ঢাকার পুরানো ও নতুন দুই ভাষাকে মিশিয়ে দিয়েছে, যা গল্পের মুডে যথাযথ অবদান রেখেছে। অনেক সময় দৃশ্যগুলো এমনভাবে সাজানো হয়েছে যেন দর্শক শহরের কোণে কোণে যাত্রা করে বেড়াচ্ছে, বিশেষ করে ঘনবসতিতে ঢাকা শহরের প্রেক্ষাপট খুব ভালোভাবে ফুটে উঠেছে। কালার স্কিমে বেশ কিছু ভিব্রেন্ট রঙ বেছে নেওা হয়েছে, যা অ্যাকশন ও থ্রিলার মুডে এখনও শক্তি যোগ করেছে।
তবে ভিএফএক্স-এর ক্ষেত্রে কিছুটা বিস্ময় দেখা গেছে। ছোট বাজেটে কাজ করলেও এ কিছু ক্ষেত্রে প্রকৌশলগত দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। কয়েকটি দৃশ্যে ভিএফএক্স-র বানানো হলেও তা খুব বাস্তবসম্মত ঠেকেছে না। বিশেষ করে ফাইট সিক্বেন্সে কিছু প্রযুক্তিগত অন্তর দেখা যায়—যেখানে ক্যামেরার আঙ্গিক, স্টেজিং এবং কাটা/মেশিং-এ অসতর্কতা কিন্তু বেশ লক্ষণীয়। এছাড়া একই বিট এবং বিজিএম একাধিকবার ব্যবহৃত হয়েছে, যা দর্শকের মনোযোগ হ্রাস করেছে।
তবে এমন সব প্রযুক্তিগত ছোটখাটো ভুল অতিক্রম করে সিনেমাটি সুন্দরভাবে তার রূপ তুলে দিয়েছে। বিশেষ করে হ্যান্ডবেল্ড ক্যামেরার ব্যবহার ছিল দৃশ্যগুলোকে অনেকটা জনজীবনের বাস্তবতায় নিয়ে এসেছে। মোটকথা, দৃশ্যগতভাবে ‘ইনসাফ’ অনেকটাই স্থিতিশীল এক বিনোদন, যেখানে কিছু অস্পষ্টতা থাকলেও তার মূল স্ট্রেন্থ ধরা যায়।
৭. মোশন এবং অ্যাকশন সিক্স্যুন্স: রক্তাক্ত বাস্তবতা
বাংলাদেশের কমার্শিয়াল সিনেমার ফাইট সিক্বেন্সের মধ্যে ‘ইনসাফ’ তার নিজের একটি ভাষা তুলে ধরতে চেয়েছে। সিনেমায় দুই গুরুত্বপূর্ণ গ্যাংস্টার এবং পুলিশ সদস্যদের মধ্যে হনাহানিমূলক লড়াই রয়েছে, যা তরঙ্গ তুলেছে। প্রথমার্ধে তাসনিয়া ফারিণের দুটি অ্যাকশন দৃশ্য দর্শকদের মনে একটা ঝাঁকুনির মতো কাজ করেছে। দ্বিতীয়ার্ধে শরীফুল রাজের ফাইট দৃশ্যগুলো ছিল ঠাম কায়দায়।
তবে কিছু অংশে মনে হয়েছে সিকোয়েন্সগুলো পুনরাবৃত্তিমূলক—কিছু কাঁপারসার অ্যাঙ্গেল বা স্টাইলগুলো আদপে আবারও লক্ষ্য করা যায়, যা কাহিনীর রসায়নে যথাযথ মাত্রা যোগ করতে পারেনি। তবে যখন ভালোভাবে এযদি অঙ্গিকভাবে ক্যামেরা এবং সাউন্ড এফেক্টস যুক্ত করা হতো, তখন এগুলো আরও বেশি প্রভাব ফেলতে পারতো।
সর্বোপরি, ‘ইনসাফ’-এর অ্যাকশন দৃশ্যগুলোতে নির্মাতা যে নির্দিষ্ট ভাবনা রেখেছেন—তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যদিও বাজেটের সীমাবদ্ধতার কারণে কিছু মোশন শট খুব দৃশ্যমানভাবে ন্যাচারাল হতে পারলো না, তবুও অল্প কিছু পর্যাপ্ত তীব্রতা ও বাস্তবতা রেখেই এটিকে দক্ষতার সঙ্গে উপস্থাপন করা গেছে।
৮. মিউজিক, ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর ও গান
‘ইনসাফ’ সিনেমায় মোট ৪টি গান রয়েছে, যা একবার শুনলে মনোযোগ পায়ও। গানগুলো দ্রুত পাতায় না থেকে দ্রুত দর্শকের ক্ষুধা মিটিয়ে দেয়। তবে এগুলো মূল স্লট ভাঙেনি। ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর (BGM)–এর ব্যবহার মোটামুটি, মাঝে মাঝে এমনকি প্রায়ই সেই একটি শূন্যতা অনুভব করায়—আবার গুঞ্জন কিছু ফাইট সিক্স্যুন্সে রেশিও তৈরি করেছে। একই BGM অনেকদফা ব্যবহার করা হয়েছে, যা সিনেমার গতিতে সকালে ঘোলা পানির মতো।
তবে গানগুলো প্রতিষ্ঠানগত মানে বেশ শক্তিশালী। প্রথম গানটি ড্রাম্যাটিক, যেখানে ইমোশন ও উত্তেজনার ভারসাম্য মেলে। দ্বিতীয় গানটি প্রেমময়, যেখানে তোলে ওঠে চরিত্রগুলোর সম্পর্কের আবেগ। তৃতীয় গানটি থিমেটিক, যেখানে গল্পের কণ্ঠবদ্ধ ড্রামার সুর অনুভূত হয়। চতুর্থ গানটি হলো ক্লাইম্যাক্স সমর্থনকারী, যা পূর্ণাঙ্গ পরিচ্ছন্ন সমাপ্তিতে যোগ করে।
সিনেমাটোলের মিউজিক্যাল যাত্রা ধারাবাহিক হলেও সেটির শেষাংশে গানের কার্যকারিতা স্পষ্ট হলেও মাঝপথে ফিলিং বলে কিছু একঘেয়ে মনে হয়। তবে সামগ্রিকভাবে, গান ও স্কোর ছবিতে বাস্তবতা ও আবেগ প্রভূতভাবে যোগ করেছে, যদি একটু বৈচিত্র্য থাকতো তা আরও ভালো হতো।
৯. সামাজিক বার্তা ও থিম
সাম্প্রতিক সময়ে সিনেমাগুলির মধ্যে ‘ইনসাফ’ আলাদা একটি জায়গা পেয়েছে কারণ এটি শুধু বিনোদন নয় বরং একটি সামাজিক বার্তা দিচ্ছে। দুর্নীতির মিথ, ক্ষমতার লালসা ও সাধারণ মানুষের দুরাবস্থা—যেগুলো হলো সিনেমার অন্যতম থিম। এএসপি জাহান একজন ন্যায়ের প্রতীক, কিন্তু সে নিজেও এই জটিল জঞ্জালের মধ্যে আটকা পড়ে যায়।
এই গল্পে তুলে ধরা হয়েছে, যেদিন একজন ব্যক্তির অতীত রঙিন হয়ে ওঠে আর সমাজ তার বিচার শুরু করে, তখন আসল ‘ইনসাফ’ কোথায়? এই প্রশ্ন নিয়েই সিনেমা গোটা আবর্তিত হয়েছে। আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়েছে যখন দেখানো হয়েছে—যতই একজন অপরাধী হোক না কেন, মানুষের জীবনে ভালো বা খারাপ দুইয়ারই প্রভাব আছে, এবং তার বিচার কখনো কখনো অন্য আর্থ–সামাজিক স্তরের উপরে ভাসিয়ে তোলে। সেই বিচার বিশ্লেষণ প্রধান থিম—"সত্য কি শুধুমাত্র আইনের বিচার, নাকি সচেতন মানুষের বিচার?”
১০. দর্শক প্রতিক্রিয়া ও বক্স-অফিস প্রভাব
দর্শকরা মূলত দুটি ভিন্ন ধরণের প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। একটি বিভাগ বলছে—"সিনেমাটি আমাদের সমাজের রূপ তুলে ধরে ভালো করেছে", কিন্তু অন্য একটি অংশ বলছে—”কিছু দৃশ্য ছিল একটু অসম্পূর্ণ, VFX দুর্বল।” তবে বেশিরভাগই শরীফুল রাহের অভিনয়, তাসনিয়া ফারিণের আত্মবিশ্বাস ও কিছু আকর্ষণীয় ফাইট সিক্বেন্সের প্রশংসা করেছে।
বক্স-অফিসে তবে ‘ইনসাফ’ কে গ্রহণ করা হয়েছে স্বাভাবিক থেকে উপরে। প্রথম সপ্তাহে মুনাফার পরিধি স্বাভাবিক ছিলো। তবে সামাজিক মাধ্যম—ফেসবুক, টুইটের মাধ্যমে—কিছু 'স্পয়লার ফ্রি' ট্রেন্ডি ‘ডায়লগ’-এর ব্যবহার নিয়ে আলোচনায় এসেছে। এইভাবে সিনেমাটি দুই-চেয়ার-এক ভালুক যুগে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
১১. সিনেমাটির সাহসী উপস্থাপনা: কি ছিল ব্যতিক্রম?
‘ইনসাফ’ সিনেমাটি যেটা সাহসের সঙ্গে করেছে তা হলো—একটি মানবিক এবং রাজনৈতিক বাস্তবতার গল্পকে বাণিজ্যিক ফর্ম্যাটে বলার চেষ্টা। সাধারণত এই ধরনের থিম বড় নির্মাতার হাতেই সীমাবদ্ধ থাকে, কিন্তু সঞ্জয় সমাদ্দার নতুন এবং কম বাজেটের একটি টিম নিয়েই সেই প্রচেষ্টায় এগিয়েছেন। যেখানে বেশিরভাগ কমার্শিয়াল সিনেমা শুধু প্রেম বা অ্যাকশন নির্ভর হয়, ‘ইনসাফ’ সেখানে ব্যতিক্রম।
এখানে দুর্নীতির চিত্র বাস্তবতার মূলে গিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে। সমাজের ‘সিস্টেম’-এর ভেতরের ঘুণ ধরার দৃশ্যগুলো সরাসরি দেখানো হয়েছে, যা অনেক পরিচালক এড়িয়ে যান। এই সাহসিকতা শুধু গল্পে না, বরং কিছু দৃশ্যায়নের মধ্যেও আছে। যেমন, ক্লাইম্যাক্সে এক বড় সত্যের উন্মোচন যা দর্শককে ভাবতে বাধ্য করে—এই ন্যায় কি সত্যিকারের, না এটা কেবল প্রতীক?
এছাড়াও ট্রেন্ডি ডায়লগগুলো এবং ক্যামিওর ব্যবহার দেখায় যে নির্মাতা দর্শকদের রুচির দিকটাও মাথায় রেখেছেন। তিনি কেবল নিজের গল্প বলতেই ব্যস্ত ছিলেন না, বরং গল্প ও বিনোদনের মধ্যে এক ব্যালেন্স রাখতে চেয়েছেন।
Related Posts
১২. দুর্বল দিকসমূহ এবং সমালোচনার জায়গা
যেমনটি ইতিপূর্বে বলা হয়েছে, সিনেমাটির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা। বাজেট স্বল্পতা ঢাকার জন্য পরিচালক অনেক চেষ্টা করেছেন, তবে সবসময় সফল হননি। কিছু ভিএফএক্স দৃশ্য খুবই অপরিণত মনে হয়েছে, যেখানে চরিত্রের মুখাবয়ব এবং ব্যাকগ্রাউন্ড মিশ্রণে বাস্তবতা অনুপস্থিত ছিল।
এছাড়াও স্ক্রিনপ্লের কিছু অংশ খুব দ্রুতগতির আবার কিছু অংশ অপ্রয়োজনীয়ভাবে ধীর। ফার্স্ট হাফে একধরনের শিথিলতা থাকে, যেখানে ইমপ্যাক্ট কম, তবে বিরতির আগে এক শকিং মোমেন্ট কিছুটা উত্তেজনা সৃষ্টি করে। কিন্তু এই গতি ক্লাইম্যাক্সে গিয়ে আবার অসংলগ্ন হয়ে পড়ে। বিশেষ করে চরিত্রদের সম্পর্ক গড়ে ওঠার সময় প্রয়োজনের তুলনায় কম ছিল।
তাসনিয়া ফারিণের এক্সপ্রেশনে কিছুটা কৃত্রিমতা লক্ষ্য করা গেছে, যদিও সেটা তার প্রথম কমার্শিয়াল সিনেমা হওয়ায় স্বাভাবিক। এছাড়া একই BGM বারবার শোনা গেছে, যেটা কিছু দৃশ্যে বিরক্তিকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজের কিছু অ্যাকশন দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি কিছুটা দর্শক ক্লান্তি সৃষ্টি করেছে।
১৩. সিনেমাটির ভবিষ্যৎ প্রভাব ও ইন্ডাস্ট্রিতে অবস্থান
‘ইনসাফ’ সিনেমাটি হয়তো একদম নিখুঁত কোনো প্রজেক্ট নয়, কিন্তু এটি যে একটি পাথর ছুঁড়েছে stagnant ধারা ভাঙার জন্য, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এই সিনেমাটি প্রমাণ করেছে যে—মানবিক গল্প বলার জন্য বড় বাজেটের প্রয়োজন নেই, বরং প্রয়োজন সাহস, ভালো স্ক্রিপ্ট, এবং চরিত্রনির্ভর অভিনয়।
এটি ইন্ডাস্ট্রির তরুণ নির্মাতাদের অনুপ্রাণিত করতে পারে। গল্পে সমাজের বাস্তবতা তুলে ধরার সাহস, এবং তা ফিকশনাল ফর্মে দর্শকদের কাছে উপস্থাপন করার ধরণ ইন্ডাস্ট্রিকে একটি নতুন দৃষ্টিকোণ দিয়েছে। আর বাণিজ্যিক সিনেমায় তাসনিয়া ফারিণের মতো নতুন মুখের উপস্থিতি ভবিষ্যতের জন্য আশাব্যঞ্জক।
এই সিনেমা যদি আন্তর্জাতিক কোনো প্ল্যাটফর্মে যায়, তাহলে এটি আরও প্রশংসা কুড়াতে পারে, কারণ এর থিম গ্লোবালি রিলেটেবল। শুধু প্রযুক্তিগত দিকে আরও সচেতন হলে ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রজেক্ট আন্তর্জাতিক মর্যাদা অর্জন করতেও সক্ষম হবে।
১৪. কাহিনীর মানবিক বার্তা: প্রতিশোধ নাকি ইনসাফ?
সিনেমার মূল জিজ্ঞাসা ছিল: ‘ইনসাফ’ আসলে কী? একজন গ্যাংস্টার কি শুধুই অপরাধী, না কি তার মধ্যেও থাকে একজন মানুষের দুর্বলতা, ভালোবাসা আর যন্ত্রণার ছাপ? ইউসুফ চরিত্রটি শুধু ভয়ঙ্কর নয়, বরং সে একটি কাহিনীর মধ্যমণি—যেখানে প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে ওঠে তার মানবতা।
কাহিনীর মধ্য দিয়ে পরিচালক দেখিয়েছেন, বিচার কেবল আদালতের কাঠগড়ায় হয় না। কখনো কখনো ন্যায়ের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাওয়া যায় ক্ষতবিক্ষত চোখের একফোঁটা অশ্রুতে, অথবা একটি আত্মদহনমূলক সিদ্ধান্তে। সিনেমাটি এই বাস্তবতাকেই পর্দায় তুলে ধরেছে।
সুতরাং এটি শুধুই অ্যাকশন সিনেমা নয়। এটি একটি স্পিরিচুয়াল জার্নিও বটে। সমাজে যেসব দুর্নীতি আমরা খালি চোখে দেখি, তাদের পেছনে লুকানো ইতিহাস হয়তো এমনই মানবিক কাহিনী।
১৫. সার্বিক মূল্যায়ন
সবকিছু মিলিয়ে, ‘ইনসাফ’ একটি সাহসী প্রচেষ্টা, যা সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও মনে রাখার মতো একটি প্রজেক্ট। গল্পের থিম, মানবিক বার্তা, কিছু অভিনয় এবং বাস্তবতাভিত্তিক চরিত্র গঠনের ক্ষেত্রে এটি সফল। যদিও প্রযুক্তিগত দুর্বলতা ও কিছু স্ক্রিপ্টিং ঘাটতি সিনেমার গতি কমিয়ে দিয়েছে, তারপরও এটি নির্দ্বিধায় একটি প্রশংসনীয় প্রচেষ্টা।
‘ইনসাফ’ আমাদের মনে করিয়ে দেয়—একটি সিনেমা কেবল মসৃণ ভিজ্যুয়াল নয়, বরং তা হতে পারে সমাজের আয়না, অথবা এক গভীর প্রশ্নের প্রতিধ্বনি: সত্যের মুখ কী কেবল একরকম হয়?
উপসংহার
‘ইনসাফ’ কোনো পারফেক্ট সিনেমা নয়, তবে এটি একটি পারফেক্ট শুরু। বাংলাদেশের সিনেমার ভবিষ্যতের জন্য এটি হতে পারে একটি রোডম্যাপ। তরুণ নির্মাতা, অভিনয়শিল্পী এবং গল্পকারদের জন্য এই সিনেমা এক নতুন আশার আলো দেখায়। সীমাবদ্ধতা থাকলেও নির্মাতা সঞ্জয় সমাদ্দার তার আন্তরিকতা, চিন্তা ও সাহস দিয়ে প্রমাণ করেছেন—ভালো গল্প হলে তা দর্শকের মন জয় করবেই। আমাদের দরকার এমন আরও উদ্যোগ, যেখানে বাণিজ্যিকতার পাশাপাশি থাকবে মানবিকতা ও বার্তা।
 
![Insaaf [ইনসাফ] Bangla Movie Review](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEgoQuXgPJHucgihHQHKz3Z3kvPtlhpW241dCAoHgv__hHiePEaw9BUeW8-NplSD96Di1QBO4KHiPTUgQy3t-qFbiRrLMKIDwXWvlxd_KzrJfZEblb2uCdyt3m_ieIoBUcH0Sn4iI34dhlo2YaP5Kttq03HecU2vH0kDkEN8kiDZQbeu7dLvkhlPZ6I3ghc/w200-h200-p-k-no-nu/Insaaf.jpg)