স্তন ক্যানসার শুধু নারীদের নয়, পুরো সমাজের জন্যই এক উদ্বেগের বিষয়। তবে আশার কথা হলো — গবেষণা বলছে, আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসে সামান্য সচেতনতা ও পরিবর্তন আনলেই এই রোগের ঝুঁকি অনেকটা কমানো সম্ভব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটি জানিয়েছে, সঠিক খাবার, ব্যায়াম ও ওজন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অন্তত ৩০–৪০% স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি প্রতিরোধ করা যায়।
১. প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় ফলমূল ও শাকসবজি রাখুন
রঙিন ফল ও শাকসবজি শুধু চোখের আরাম নয়, শরীরেরও রক্ষাকবচ। এসব খাবারে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ফাইটোকেমিক্যাল এবং ভিটামিন সি, ই ও বিটা-ক্যারোটিন শরীরে জমে থাকা ক্ষতিকর ফ্রি র্যাডিক্যাল ধ্বংস করে।
এই ফ্রি র্যাডিক্যালই কোষে ক্ষতি করে ক্যানসারের জন্ম দেয়। তাই প্রতিদিনের প্লেটে রাখুন — গাজর, টমেটো, ব্রোকলি, পালংশাক, বিট, ক্যাপসিকাম, পেঁপে, ডালিম, আমলকী ও বেরিজাতীয় ফল (ব্লুবেরি, স্ট্রবেরি ইত্যাদি)।
অতিরিক্ত টিপস
- প্রতিদিন অন্তত পাঁচ রঙের ফল বা শাকসবজি খান।
- ফলমূল কাঁচা অবস্থায় খাওয়ার চেষ্টা করুন যাতে পুষ্টিগুণ অক্ষুণ্ণ থাকে।
- প্রসেস করা জুস বা প্যাকেটজাত ফলের বদলে প্রাকৃতিক ফল বেছে নিন।
Related Posts
২. চর্বি কমান, প্রোটিন বাড়ান
ফাস্টফুড, প্রক্রিয়াজাত মাংস ও অতিরিক্ত তেল-চর্বি শরীরে প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে। এগুলো স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়।
এর পরিবর্তে উচ্চমানের প্রোটিনযুক্ত খাবার যেমন মাছ, ডিম, ডাল, টকদই, ছোলা ও মুরগির মাংস রাখুন। এগুলো কোষ পুনর্গঠনে সাহায্য করে ও ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে।
💡 গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত মুরগির মাংস ও ডালজাতীয় খাবার খেলে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি প্রায় ১৫% কমে।
৩. ওমেগা–৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের গুরুত্ব
ওমেগা–৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ক্যানসার প্রতিরোধে এক কার্যকরী পুষ্টি উপাদান। এটি শরীরে প্রদাহ কমায়, কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি রোধ করে এবং হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখে।
ওমেগা–৩ পাওয়া যায় যেসব খাবারে
- তৈলাক্ত মাছ — সালমন, সারডিন, রুই, কাতলা
- বাদাম — আখরোট, কাঠবাদাম
- বীজ — ফ্ল্যাক্সসিড (তিসি), চিয়া সিড
- অলিভ অয়েল ও সরিষার তেল
প্রতি সপ্তাহে অন্তত দুবার মাছ খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি ভাজা খাবার কমিয়ে তেলে সিদ্ধ বা গ্রিল করা খাবার বেছে নিন।
৪. চিনি ও অ্যালকোহল থেকে দূরে থাকুন
অতিরিক্ত চিনি, সফটড্রিংক বা অ্যালকোহল ইনসুলিনের ভারসাম্য নষ্ট করে এবং শরীরে ইনফ্ল্যামেশন তৈরি করে। এর ফলে ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়।
মিষ্টি পানীয়র পরিবর্তে পানি, ডাবের পানি বা গ্রিন টি পান করুন। গ্রিন টির মধ্যে থাকা ক্যাটেচিন নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট স্তন ক্যানসার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে।
স্বাস্থ্যকর বিকল্প পানীয়
- গ্রিন টি বা হারবাল টি (চিনি ছাড়া)
- ডাবের পানি
- তাজা ফলের স্মুদি (চিনি ছাড়া)
- লেবু ও পুদিনা মিশ্রিত পানি
৫. শরীরচর্চা ও ওজন নিয়ন্ত্রণ
খাদ্যাভ্যাস যতই ভালো হোক, ব্যায়াম ছাড়া শরীর সুস্থ রাখা সম্ভব নয়। নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপ শরীরে এস্ট্রোজেন হরমোনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে, যা স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি হ্রাস করে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলেন
প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হালকা ব্যায়াম যেমন হাঁটা, সাইকেল চালানো, যোগব্যায়াম বা সাঁতার করুন। যারা দীর্ঘ সময় বসে কাজ করেন, তারা প্রতি ঘণ্টায় ৫ মিনিট দাঁড়িয়ে হাঁটলে রক্তসঞ্চালন ভালো থাকে।
ওজন নিয়ন্ত্রণও গুরুত্বপূর্ণ — স্থূলতা শরীরে অতিরিক্ত এস্ট্রোজেন উৎপাদন ঘটায়, যা ক্যানসার কোষকে সক্রিয় করতে পারে।
৬. মানসিক চাপ কমান ও পর্যাপ্ত ঘুম নিন
অতিরিক্ত মানসিক চাপ শরীরের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল করে দেয়, যার ফলে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে। প্রতিদিন কিছু সময় নিজের জন্য রাখুন—ধ্যান, বই পড়া, সঙ্গীত শোনা বা প্রিয়জনের সঙ্গে সময় কাটান।
সুস্থ ঘুম শরীরকে পুনরুজ্জীবিত করে। দিনে অন্তত ৭–৮ ঘণ্টা ভালোভাবে ঘুমানো ক্যানসার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে।
উপসংহার
খাদ্যাভ্যাস কোনো জাদু নয়, বরং প্রতিরোধের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। নিয়মিত স্বাস্থ্যকর খাবার, পর্যাপ্ত ব্যায়াম, ওজন নিয়ন্ত্রণ ও মানসিক স্বাস্থ্যের যত্নই স্তন ক্যানসার প্রতিরোধের মূল চাবিকাঠি।
নিজেকে ভালো রাখুন, নিয়মিত মেডিকেল চেকআপ করান এবং সচেতন থাকুন— কারণ প্রতিরোধই সেরা প্রতিকার।
সূত্র: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO), আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটি, ব্রেস্ট ক্যানসার রিসার্চ ফাউন্ডেশন
