শেষ রাতের ট্রেন ভুতের গল্প | Train Journey horror Story

টাইমলুপ একটি চমকপ্রদ থ্রিলার গল্প যেখানে ঢাকা-ঠাকুরগাঁ ট্রেনে ঘটে রহস্যময় ঘটনা। রকিব নামের চরিত্রকে ঘিরে সময়ের লুপ এবং অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কাহিনী।
Train

টাইমলুপ (প্রথম পর্ব)

ট্রেনের কেবিনে ঢুকে আমার মনটা ভাল হয়ে গেল। কেবিনটা আশ্চর্য রকম ঝকঝক তকতকে। আমি ধরেই নিয়েছিলাম কেবিন থাকবে চরম অপরিষ্কার, মেঝে বাদামের খোসা দিয়ে ভর্তি, এখানে ওখানে পানির খালি বোতল পড়ে থাকতে দেখব আর যদি কপাল খারাপ হয় তাহলে দেখব কেউ একজন আমার সীটে চা ফেলে ভিজিয়ে রেখেছে। আমি ব্যাগে করে একটা এক্সট্রা চাদর নিয়ে এসেছি। স্লীপিং সীটে বিছিয়ে শুয়ে পড়ব ভেবে।

এখন মনে হচ্ছে সেটা না আনলেও চলত। কোন ময়লা দূরে থাক কোথাও বাদামের একটা খোসা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে কেউ এইমাত্র পরিষ্কার করে রেখে গেছে সব। চমৎকার ব্যাপার, বাংলাদেশ রেলের দেখা যাচ্ছে অনেক উন্নতি হয়েছে।

কেবিনে চার স্লীপিং সিটের দুইটা এখনো খালি। আমার মাথার উপর বার্থের যাত্রী এখনও আসেন নি। পাশের সিটে একজনকে দেখা যাচ্ছে। আমি সময় নিয়ে তার দিকে তাকালাম। কেবিনের যাত্রীদের চেহারা একটু ডিটেইলস দেখে রাখা ভালো, সারারাতের সঙ্গী, কার মনে কি আছে বলা মুস্কিল। চোর বাটপারে দেশ ভর্তি, হয়ত ভোরে উঠে দেখা গেল একজন অন্যদের মালপত্র নিয়ে কেটে পড়েছে।

আমার অন্যপাশের সীটের লোকটা মধ্যবয়স্ক। বয়স আন্দাজ পঁয়তাল্লিশের আশেপাশে। মাথায় ছোট ছোট কাঁচাপাকা চুল। সাধারণ শার্ট-প্যান্ট পরা। মজার ব্যাপার হচ্ছে লোকটাও এতক্ষণ আমার দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে ছিল। মনে হচ্ছে সেও মাপছে আমাকে। আমি উপরের বার্থের দিকে তাকাতে সে বলল,

“আর কেউ আসবে না, আজ আমরা দুইজনই যাত্রী।”

আমি ঘড়ি দেখলাম, ট্রেন ছাড়তে এখনো মিনিট পনের বাকি। কাজেই আর কেউ আসবে না সেটা বলা হাস্যকর। কিন্তু লোকটাকে কিছু না বলে আমি চাদর বিছিয়ে আমার সীটে শুয়ে পড়লাম। শুধু শুধু কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।

Related Posts

এখন কিছু বললেই গল্প শুরু হবে বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু লোকটা ছাড়ল না। সে আবার বলল,

“ভাইজান আজ কয় তারিখ?”

নিঃসন্দেহে ফালতু প্রশ্ন। আজ কত তারিখ সেটা সব যাত্রীরই জানা। পকেটে সবার ট্রেনের টিকিট। তবু আমি ভদ্রতা করে বললাম, ‘আঠারোই মার্চ।’ বলেই চট করে ঘুরে গেলাম।

লোকটার আর কোন প্রশ্নের জবাব দেয়ার ইচ্ছা নেই। এখনই সে গল্প শুরু করবে বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু আমার আজ রাতের জন্য অন্য প্ল্যান। আমি ব্যাগ থেকে হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের ‘ফিনিশড’ বইটা বের করে সেটাতে অনেকক্ষণের জন্য ডুবে গেলাম।

আলান কোয়ার্টারমেইনকে জুলু রাজা আটকে ফেলেছে, মেরে ফেলবে না বাঁচিয়ে রাখবে বোঝা যাচ্ছে না এমন টানটান উত্তেজনার মধ্যে আছি এই সময় পাশের সীটের লোকটা ডাকল,

“ভাইজান ও ভাইজান।”

আমি বই সরিয়ে তার দিকে তাকালাম। বিরক্ত লাগছে। লোকটা আমার বিরক্তি দেখে একটু মিইয়ে গেল। বলল, ভাইজান একটু পরে বেয়ারা চা দিয়ে যাবে, মুখে দেবেন না। ওই চায়ের কাপে একটা মরা মাছি ডুবানো আছে।

এই রকম অদ্ভুত কথা শুনে আমি একটু উঁচু হয়ে লোকটাকে ভালভাবে দেখলাম। সে তার সীটে চুপচাপ বসে আছে। একই রকম জুলজুল চোখে আমার দিকে তাকানো। বয়স আমার থেকে অন্তত পনের বছর বেশি হওয়ার পরও আমাকে কেন ভাইজান ভাইজান বলে ডাকছে সেটাও পরিষ্কার না।

একটা কারণ হতে পারে সে হয়ত একদম অজ পাড়াগাঁয়ের মানুষ, আমার বেশ ভূষা দেখে আমাকে উঁচু শ্রেনীর কেউ ভেবে বসে আছে। কিন্তু তার এই উদ্ভট কথা বলার মানে কি? বেয়ারা চা নিয়ে আসবে আর সেটাতে মাছি ডুবানো থাকবে এই রকম অর্থহীন কথার কারণ কি?

আমি চারপাশে তাকিয়ে বুঝলাম ট্রেন চলছে এবং এই কেবিনে আমরা মাত্র দুইজন যাত্রী। লোকটার কথাই ঠিক, আর কেউ ওঠেনি। তবে আজ সোমবার, উইক ডেইজ, এমন দিনে ঠাকুরগাঁয়ে যাওয়ার কেবিন যাত্রী কম থাকাই স্বাভাবিক। লোকটা হয়ত ঐ আন্দাজ থেকেই বলেছে।

ট্রেনের কেবিনের দরজায় নক হলো, আমি খুলে দিতেই এক বেয়ারা একটা চায়ের কাপ আমার হাতে দিয়ে বলল, “স্যার আপনার চা।”

আমি কাপ হাতে নিয়ে চিন্তিত হয়ে গেলাম। আমি কোন চায়ের অর্ডার দেই নি। সম্ভবত বেয়ারা ভুল করে অন্য কোন কেবিনের অর্ডার এখানে দিয়ে গেছে। কিন্তু ফেরত দেয়ার উপায় দেখছিনা, বেয়ারা চায়ের কাপ হাতে দিয়েই চলে গেছে।

আমার চা খাওয়ার খুব একটা অভ্যাস নেই, তবু এই রকম চমৎকার একটা বই পড়ছি, সারারাত পড়ে শেষ করার প্ল্যানও আছে, কাজেই এক কাপ চা চলতে পারে।

আমি চায়ের কাপ মুখের কাছে নিতেই পাশের সীটের লোকটা বলল, “ভাইজান চায়ের ভিতর মাছি ডুবানো আছে। খাইয়েন না।”

আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। কি আজগুবি কথাবার্তা! আমি চায়ের কাপ নামিয়ে বললাম, আপনি কিভাবে জানেন চায়ের ভিতর মাছি ডোবানো?

লোকটা একটু মিইয়ে গেল। বলল, “রাগ কইরেন না ভাইজান। আপনার ভালোর জন্য বললাম। আমি জানি, কারণ এর আগে কয়েকজন ওই চা খেয়ে পরে কাপের নীচে মাছি পাইছে। একজন তো বমিও করছে। বিশ্বাস না করেন আপনি চায়ের নীচে একটা কিছু দিয়ে নাড়া দিয়ে দেখতে পারেন।”

কি উদ্ভট কথা রে ভাই! এই চা তো আমি খাচ্ছি, আবার অন্যরা খাবে কিভাবে? নিশ্চয়ই সে এই ট্রেনের অন্য চায়ের কথা বলতে চেয়েছে। অন্য চায়ে মাছি থাকলেই যে এই চায়ের কাপেও থাকবে তার কোন মানে নেই।

আমি চায়ের কাপ তুলে নিলাম চুমুক দেব। লোকটা বলল, “ভাইজান আপনি আমার কথা বিশ্বাস করলেন না পরে কিন্তু নিজেই কষ্ট পাইবেন।”

আমার এতো রাগ হলো। আমি কেবিনে রাখা ময়লা ফেলা বিনের মধ্যে চা ঢেলে দিলাম। কেউ যদি বলতে থাকে চায়ে মাছি আছে, মাছি থাক বা না থাক ওই চা আর খাওয়া যায় না, এমনিতেই গা গুলাতে থাকে। চা ঢেলে কাপটা টেবিলের উপর রাখলাম। কাপের দিকে তাকিয়ে দেখি নীচে নীল রঙের একটা মাছি। চায়ের মধ্যে ডুবে ছিল। নিশ্চয়ই চিনিতে ছিল, বেয়ারা চিনি যখন চামচ দিয়ে ঢেলেছে খেয়াল করে নি চায়ের কাপের মধ্যে মরা মাছি চলে গেছে।

কিন্তু এই লোকটা সেটা জানল কিভাবে? এটাও কি আন্দাজ? কিন্তু সে এতো নিশ্চিতভাবে বলছিল যে আন্দাজ বলে মনে হয় না, মনে হয় সে দেখেছে। কিন্তু কিভাবে?

টাইমলুপ (দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব)

আমি সীটের উপর বসে আছি। পাশে হেনরী রাইডার হ্যাগার্ডের দারুন বই ‘ফিনিশড’ আর টানছেনা এখন। হচ্ছে কি একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবার চেস্টা করছি। পারছি না। মাথায় নানা চিন্তা জট পাকিয়ে যাচ্ছে। সামনের সীটে লোকটা পা ঝুলিয়ে বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার অস্বস্তি লাগছে। আমি ঘড়ি দেখলাম, রাত পৌনে তিনটা। ট্রেন ছুটে চলছে তীব্র গতিতে, জানালার বাইরে অন্ধকার আকাশ, ঘরবাড়ি, গাছপালা সবই সরে যাচ্ছে।

লোকটা হঠাৎ বলল, “ভাইজান একটা জিনিস দেখবেন?”

আমি সরু চোখে তাকালাম। ব্যাটা আমাকে ভালই ধাঁধায় ফেলেছে সন্দেহ নাই। এখন আবার কি খেলা দেখাতে চাচ্ছে কে জানে!

লোকটা তার হাতের ঘড়িতে সময় দেখল, বলল, “ভাইজান ঠিক তিনটার সময় গাড়ি একটা স্টেশনের কাছে এসে স্লো হয়ে যাবে। এরপর জানালা দিয়ে তাকায় দেখবেন স্টেশনের উপর একজন মানুষ আরাকজনকে গুলি করে মেরে ফেলছে।”

আমি বিশেষ উৎসাহ দেখালাম না। লোকটা যা বলছে ওইটাই ঘটবে সন্দেহ নাই। ব্যাটা কোনভাবে আমার চিন্তার উপর প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছে। একধরনের হিপনোটাইজ নিশ্চয়ই।

ভাবতে ভাবতে দেখি ট্রেনটা স্লো হয়ে গেল। আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি ট্রেনটা একটা ছোট স্টেশনের প্লাটফর্ম পার করছে। হঠাৎ এক লোক হাত উঁচু করে পিস্তল দিয়ে গুলি করল, সামনের লোকটাকে পড়ে যেতে দেখলাম।

আমি উত্তেজনায় জানালার কাছে চলে গিয়েছিলাম। সরে এসে আবার সীটে বসলাম। মাথা গরম হয়ে গেছে। তাকিয়ে দেখি সামনের লোকটা জুল জুল করে আমাকে দেখছে। মনে হল ব্যাটা একটু কৌতুকের চোখে তাকিয়ে আছে এবার।

আমি জোর করে সীটের উপর শুয়ে পড়লাম। তারপর ফিনিশড বইটা মুখের উপর তুলে ধরে পড়ার ভাণ করতে লাগলাম। সকাল হওয়া পর্যন্ত আমি এভাবেই শুয়ে থাকলাম। এক লাইনও বই পড়া হলো না, কিন্তু ভাব করলাম বইতে ডুবে আছি।

সকালে ঠাকুরগাঁ স্টেশনে এসে পৌঁছল ট্রেন। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি বাইরে ঝকঝকে রোদ উঠেছে। সকালের আলো তেড়ছা হয়ে স্টেশনের উপর পড়ছে। আমার মন ভালো হয়ে গেল। রাতের অন্ধকারে লোকটার আজগুবি কথাবার্তা ভেবে হাসি লাগল।

লোকটা বলল, “ভাইজান আমার বাসা ঠাকুরগাঁর রানিশংকল গ্রাম। আমার নাম রকিব। মাস্টার বাড়ি, আমার বাড়িতে একটু খবর পাঠায় দিয়েন ভাইজান। আমারে যেন তারা উদ্ধারের ব্যবস্থা করে।”

মোবাইলে চার্জ ফুরায় গেছে ভাইজান। তাছাড়া এই কেবিনে মোবাইল কাজ করে না। আমি বাঁকা হেসে মোবাইল বের করলাম। তাকিয়ে দেখি সত্যিই নেটওয়ার্ক নাই কোন।

হেসে আমি আমার ব্যাগ নিয়ে দরজা খুলে একবার পেছনে তাকালাম। লোকটা ঠিক আমার পেছনে গাঁ ঘেষে দাঁড়িয়ে আমার কাঁধের উপর দিয়ে উঁকি দেখছে। আচমকা তাকে পেছনে দেখে আমার বুকটা ধ্বক করে উঠল। দরজা খুলতে গেলে সে বলল, “ভাইজান, আমি এখানে আটকা পড়ছি ভাইজান। আমারে বের করার ব্যবস্থা করেন ভাইজান।”

ট্রেনের দরজা খুলল না। আমি হতাশ হয়ে এসে সীটে বসে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে লাগলাম। একটু চিন্তা করেই বুঝলাম, ট্রেন আবার ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করবে। তখন কোন একজন যাত্রী উঠবে, সকালে সে যখন ট্রেন থেকে নামার জন্য দরজা খুলবে তখন রকিবের মতো আমাকেও তাকে সরিয়ে দিয়ে বের হতে হবে।

ট্রেন কমলাপুর রেল স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে। জানালা দিয়ে স্টেশনের বহু পরিচিত অবকাঠামো দেখা যাচ্ছে। টাইম লুপ সত্যিই আছে।

ট্রেনের দরজা খুলে গেল। একটি বিশ একুশ বছরের তরুণী দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল। আমাকে দেখে সে পেছন ঘুরে বলল, “আব্বা তাড়াতাড়ি ঢুকে পড়, পিছিয়ে পড়লে কেন?”

ততক্ষণে তার পেছনে কেবিনের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। মেয়েটা আমার সাথে আটকা পড়ে গেছে এই কেবিনের টাইম লুপে। আমি ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম মেয়েটার মুখে এখনো কৈশোর পেরুনো নিখাদ তারুন্যের সরলতা। কিন্তু আমাকে কোন মায়ায় জড়ালে চলবে না। আগামীকাল ঠিকঠাক এই মেয়েকে দরজা থেকে সরিয়ে দিয়ে বের হয়ে যেতে হবে।

গল্পটি এখানেই শেষ। ছোটগল্প কখনও সম্পূর্ণ হয় না। প্রকাশক অনুরোধ করেছেন এই গল্পটি নিয়ে উপন্যাস দাঁড় করাতে। সেখানে এই গল্প আরও বিস্তৃত হবে, এবং পরবর্তী ঘটনার ধারাবাহিকতা উপন্যাসে প্রকাশিত হবে।

লেখক: খোন্দকার মেহেদী হাসান

About the author

Leo
Hey! I'm Leo. I'm always eager to learn new things and enjoy sharing my knowledge with others.

Post a Comment

To avoid SPAM, all comments will be moderated before being displayed.
Don't share any personal or sensitive information.