মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া ব্যাংকের টাকা কে পাবেন?
আমরা সবাই কম-বেশি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলি বা বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করি। নিজের অনুপস্থিতিতে প্রিয়জনদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আমরা নমিনি (Nominee) নির্বাচন করি। কিন্তু যখন কোনো ব্যক্তি মারা যান, তখন তাঁর রেখে যাওয়া ব্যাংকের গচ্ছিত টাকা বা সঞ্চয়পত্রের অর্থ ব্যাংক থেকে মৃত ব্যক্তির টাকা উত্তোলন করার অধিকার কার—নমিনি, নাকি তাঁর আইনানুগ উত্তরাধিকারীদের (ওয়ারিশদের)?
বাংলাদেশে এই বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে প্রায়ই বিভ্রান্তি দেখা যায়, এবং আইনি জটিলতাও সৃষ্টি হয়। আজকের লেখায় আমরা বাংলাদেশের প্রচলিত বিভিন্ন আইন এবং আদালতের রায়ের আলোকে এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির স্পষ্ট ও বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেব, যা আপনাকে আপনার সঞ্চয়ের সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে সাহায্য করবে।
প্রাসঙ্গিক আইন ও বিধিমালা
-
ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১
ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর ১০৩ ধারার বিধান অনুযায়ী, কোনো আমানতকারী মারা গেলে, ব্যাংক তাঁর মনোনীত নমিনিকেই আমানতের টাকা প্রদান করে থাকে। ১০৩ ধারার বিস্তারিত নিচে উল্লেখ করা হলো:
(১) ব্যাংক-কোম্পানীর নিকট রক্ষিত কোন আমানত যদি একক ব্যক্তি বা যৌথভাবে একাধিক ব্যক্তির নামে জমা থাকে, তাহা হইলে উক্ত একক আমানতকারী এককভাবে বা, ক্ষেত্রমত, যৌথ আমানতকারীগণ যৌথভাবে, নির্ধারিত পদ্ধতিতে, এমন [একজন বা একাধিক] ব্যক্তিকে মনোনীত করিতে পারিবেন [যাহাকে বা যাহাদিগকে], একক আমানতকারী বা যৌথ আমানতকারীগণের সকলের মৃত্যুর পর, আমানতের টাকা প্রদান করা যাইতে পারে :তবে শর্ত থাকে যে, উক্ত একক আমানতকারী বা যৌথ আমানতকারীগণ যে কোন সময় উক্ত মনোনয়ন বাতিল করিয়া নির্ধারিত পদ্ধতিতে [অন্য কোন ব্যক্তিকে বা ব্যক্তিবর্গকে] মনোনীত করিতে পারিবেন৷
(২) উপ-ধারা (১) এর অধীনে [মনোনীত কোন ব্যক্তি] নাবালক হইলে, তাঁহার নাবালক থাকা অবস্থায় উক্ত একক আমানতকারীর বা যৌথ আমানতকারীগণের মৃত্যুর ক্ষেত্রে, আমানতের টাকা কে গ্রহণ করিবেন তত্সম্পর্কে উক্ত একক আমানতকারী বা যৌথ আমানতকারীগণ নির্ধারিত পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট করিতে পারিবেন৷
(৩) আপাততঃ বলবত্ অন্য কোন আইনের বা কোন উইলে বা সম্পত্তি বিলি বণ্টনের ব্যবস্থা সম্বলিত অন্য কোন প্রকার দলিলে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, উপ-ধারা (১) এর অধীনে কোন ব্যক্তিকে মনোনীত করা হইলে বা উপ-ধারা (২) এর অধীন কোন ব্যক্তি নির্দিষ্ট হইলে তিনি একক আমানতকারী বা ত্মেগত্রমত যৌথ আমানতকারীগণের সকলের মৃত্যুর পর, উক্ত আমানতের ব্যাপারে একক আমানতকারীর বা, ক্ষেত্রমত, সকল আমানতকারীর যাবতীয় অধিকার লাভ করিবেন, এবং অন্য যে কোন ব্যক্তি উক্ত অধিকার হইতে বঞ্চিত হইবেন৷
-
সঞ্চয়পত্র বিধিমালা
সঞ্চয়পত্র বিধিমালা ১৯৭৭ (সংশোধিত ২০১৫) এবং পেনশনার সঞ্চয়পত্র নীতিমালা ২০০০ (সংশোধিত ২০১৫)-এর বিধানগুলি নমিনির অধিকারকে আরও শক্তিশালী করে।
নমিনি থাকলে: যদি সঞ্চয়পত্রের মালিক মৃত্যুর আগে বৈধভাবে এক বা একাধিক নমিনি নির্ধারণ করে যান, তবে মালিকের মৃত্যুর পর নমিনিগণ তাঁদের নির্ধারিত অংশহারে টাকা প্রাপ্ত হবেন।
-
সরকারি ঋণ আইন ২০২২
সরকারি ঋণ আইন, ২০২২-এর ধারা ১৭ ও ১৮ অনুযায়ী, জাতীয় সঞ্চয় স্কিমের আওতায় ইস্যুকৃত সার্টিফিকেটের অর্থ নমিনি কার্যকর থাকলে নমিনিই প্রাপ্ত হবেন। সরকারি ঋণ আইন, ২০২২-এর ধারা ১৭ এ ধারক কর্তৃক নমিনি মনোনয়ন প্রদান সম্পর্কে উল্লেখিত বিধান নিচে লেখা হলো:
(১) আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে ভিন্নরূপ যাহা কিছুই থাকুক না কেন,-
(ক) সরকারি সিকিউরিটি বা জাতীয় সঞ্চয় স্কীমের আওতায় ইস্যুকৃত সার্টিফিকেটের ধারক উল্লিখিত সিকিউরিটি বা সার্টিফিকেটের প্রাপ্য অর্থ তাহার মৃত্যুর পর গ্রহণ বা উত্তোলনের নিমিত্ত বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে তাহার পক্ষে এক বা একাধিক নমিনি মনোনয়ন প্রদান করিতে পারিবে; এবং
(খ) ধারকের মৃত্যুর পর আইনানুগ প্রক্রিয়ায় নমিনি পরিবর্তন বা বাতিল না হইলে, ধারকের মনোনীত নমিনিকে বাংলাদেশ ব্যাংক বা, ক্ষেত্রমত, জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর নির্ধারিত পদ্ধতিতে সরকারি সিকিউরিটি বা জাতীয় সঞ্চয় স্কীমের আওতায় ইস্যুকৃত সার্টিফিকেট বাবদ পাওনা অর্থ প্রদান করিতে পারিবে।
(২) ধারক কর্তৃক প্রদত্ত একক নমিনি বা একাধিক নমিনির ক্ষেত্রে সকল নমিনি মৃত্যুবরণ করিলে উপ-ধারা (১) এর বিধান অনুযায়ী প্রদত্ত নমিনির মনোনয়ন বাতিল বলিয়া গণ্য হইবে।
(৩) সরকারি সিকিউরিটি হস্তান্তর করিলে, হस्तান্তরের পূর্বে প্রদত্ত নমিনির মনোনয়ন বাতিল বলিয়া গণ্য হইবে:
তবে শর্ত থাকে যে, সরকারি সিকিউরিটি কোনো আর্থিক লেনদেনের জন্য বন্ধক বা জামানত হিসাবে প্রদান করিলে, উক্তরূপ বন্ধক বা জামানত নমিনি বাতিলকে প্রভাবিত করিবে না, তবে বন্ধক বা জামানত গ্রহীতার অধিকারের সহিত নমিনির অধিকার সম্পর্কযুক্ত হইবে।
(৪) নমিনি নাবালক হইলে, ধারকের মৃত্যুর পর নমিনি সাবালক না হওয়া পর্যন্ত নমিনির পক্ষে সরকারি সিকিউরিটি বা জাতীয় সঞ্চয়স্কীমের আওতায় ইস্যুকৃত সার্টিফিকেটের প্রাপ্য অর্থ গ্রহণ বা উত্তোলনের জন্য ধারক কর্তৃক নমিনি প্রদানকালে যে কোনো ব্যক্তিকে নিয়োগ করা আইনসম্মত ও যৌক্তিক হইবে এবং উক্তরূপ নিয়োগের ক্ষেত্রে ধারকের মৃত্যুর পর নমিনি সাবালক না হওয়া পর্যন্ত নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি নাবালকের প্রতিনিধি হিসাবে গণ্য হইবে।
নমিনি বনাম উত্তরাধিকারী: কার অধিকার প্রাধান্য পায়?
অর্থ্যাৎ উপরোক্ত সকল আইন অনুযায়ী প্রতিয়মান হয় যে, মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া ব্যঅংক ও সঞ্চয়পত্রের টাকা নমিনী পাবেন। তবে, তিনি চাইলেই সম্পূর্ণ অর্থ ভোগ করতে পারবেন না। তিনি ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করার একচেটিয়া অধিকার (Exclusive Right) লাভ করলেও, উক্ত প্রাপ্ত অর্থ উত্তরাধিকারীদের মধ্যে আইননানুগ অনুযায়ী বন্ঠন করে দিবেন।
আর যদি মৃত ব্যক্তি তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা সঞ্চয়পত্রে কোনো নমিনি নির্ধারণ না করে যান, তবেই উত্তরাধিকারী বা ওয়ারিশগণ সরাসরি টাকা পাবেন। এই ক্ষেত্রে, ওয়ারিশদের প্রথমে আদালতের মাধ্যমে সাকসেশন সার্টিফিকেট (Succession Certificate) সংগ্রহ করতে হবে। এই সার্টিফিকেটের ভিত্তিতে ব্যাংক বা সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তর পার্সোনাল ল অনুযায়ী ওয়ারিশদের মধ্যে অর্থ পরিশোধ করবে।
আরও পড়ুন:ডিসপিউট লেনদেনের [Dispute Transaction] কারণ ও সমাধাননমিনি টাকা বন্টন না করলে উত্তরাধিকারীদের করণীয়
যদি নমিনি ব্যাংক বা সঞ্চয়পত্র থেকে টাকা উত্তোলন করার পর তা ওয়ারিশদের মধ্যে বন্টন না করেন এবং নিজে ভোগ করতে চান, তবে আইনানুগ উত্তরাধিকারীগণের হাতে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকে:
-
আইনের আশ্রয়
উত্তরাধিকারীগণ নমিনির বিরুদ্ধে মানি মোকদ্দমা বা সাকসেশন মামলা দায়ের করতে পারবেন।
-
টাকা পুনরুদ্ধার
আদালতের মাধ্যমে উত্তরাধিকারীগণ তাদের ন্যায্য অংশ বুঝে নিতে পারবেন।
অতএব, ব্যাংক নমিনিকে অর্থ পরিশোধ করে তার দায়িত্ব শেষ করলেও, নমিনির দায়িত্ব শুরু হয় উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সেই অর্থ ন্যায্যভাবে বন্টন করার মাধ্যমে।
শেষকথা
পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী নমিনিই প্রথমত ব্যাংক বা সঞ্চয়পত্রের টাকা উত্তোলন করবেন। তবে নমিনি এই অর্থের একমাত্র মালিক নন, বরং তিনি হলেন একজন ট্রাস্টি বা অর্থ-সংরক্ষক। এই অর্থ শেষ পর্যন্ত মৃত ব্যক্তির আইনগত উত্তরাধিকারীদের মধ্যে ধর্মীয় ও পার্সোনাল ল অনুযায়ী বন্টন করা হবে।
নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রত্যেক আমানতকারীর উচিত, অ্যাকাউন্ট খোলার সময় এমন ব্যক্তিকে নমিনি করা, যার ওপর তিনি তার পরিবার ও ওয়ারিশদের মধ্যে অর্থ সুষ্ঠুভাবে বন্টনের জন্য বিশ্বাস রাখতে পারেন। সঠিক আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উত্তরাধিকারীরা সব সময় তাদের ন্যায্য অধিকার ফিরে পাবেন।