ডায়াফ্র্যামেটিক হার্নিয়া (Diaphragmatic Hernia): নবজাতকের শ্বাসকষ্ট ও চিকিৎসা

ডায়াফ্র্যামেটিক হার্নিয়া (Diaphragmatic Hernia) কী, নবজাতকের শ্বাসকষ্টের কারণ, উপসর্গ, নির্ণয় ও চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত জানুন। সচেতন থাকুন,
Diaphragmatic

Diaphragmatic Hernia (ডায়াফ্র্যামেটিক হার্নিয়া) হচ্ছে এমন এক জটিল ও গুরুতর শারীরিক অবস্থা, যেখানে পেটের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ (যেমন: পাকস্থলী, অন্ত্র, যকৃত) একটি ছিদ্রের মাধ্যমে ডায়াফ্রামের উপর উঠে বুকে চলে আসে। এতে ফুসফুস সঠিকভাবে বিকশিত হতে পারে না এবং নবজাতকের শ্বাস-প্রশ্বাসে তীব্র জটিলতা দেখা দেয়।

১. ডায়াফ্রাম কি?

ডায়াফ্রাম হলো একটি পাতলা, গম্বুজ-আকৃতির মাংসপেশির পর্দা, যা বুক ও পেটের গহ্বরকে আলাদা করে। এটি শ্বাস-প্রশ্বাসে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে—সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে ফুসফুসে বাতাস প্রবেশ/নির্গমনে সহায়তা করে।

২. ডায়াফ্র্যামেটিক হার্নিয়ার প্রকারভেদ

২.১ জন্মগত (Congenital Diaphragmatic Hernia, CDH)

গর্ভাবস্থায় ডায়াফ্রামের বিকাশজনিত ত্রুটির ফলে একটি ছিদ্র থেকে পেটের অঙ্গগুলো বুকে উঠে যায়। দুই ধরনের:

  1. Bochdalek hernia: প্রায় ৮৫%, পিছনের দিকে (posterolateral), বেশিরভাগ সময় বামে হয়।
  2. Morgagni hernia: প্রায় ৫–১০%, সামনের দিকে (anterior), অধিকাংশ সময় ডানে হয়।

২.২ অর্জিত (Acquired Diaphragmatic Hernia)

দুর্ঘটনা, অস্ত্রোপচার বা জোরালো শারীরিক চাপ থেকে ডায়াফ্রামে ছিদ্র সৃষ্টি হতে পারে, এবং পেটের অঙ্গগুলো বুকে উঠে আসে।

৩. CDH-এর কারণসমূহ

  1. গর্ভকালীন ডায়াফ্রামের অস্বাভাবিক গঠন
  2. জেনেটিক মিউটেশন বা ক্রোমোজোম ত্রুটি (যেমন: ট্রাইসোমি ১৮)
  3. পরিবেশগত কারণ (সম্ভাব্য ইনফেকশন বা ঔষুধ)

৪. লক্ষণসমূহ (Symptoms)

৪.১ নবজাতকের ক্ষেত্রে

  1. শ্বাসকষ্ট (birth asphyxia)
  2. নীলচে ত্বক (Cyanosis)
  3. বুকের বাম পাশে শ্বাসের শব্দ কমে যাওয়া
  4. ফাঁপা বা ছোট পেট
  5. বুকে ডাক মতো গুড়গুড় শব্দ
Related Posts

৪.২ বড়দের ক্ষেত্রে

  1. বুক বা বুকের ব্যথা
  2. শ্বাস নিতে কষ্ট
  3. পেটে ব্যথা, গ্যাস জমা
  4. বুকে অন্ত্রের গুড়গুড় শব্দ

৫. রোগ নির্ণয় (Diagnosis)

৫.১ গর্ভকালীন (Prenatal)

  1. Ultrasound: গর্ভাবস্থার ১৮–২২ সপ্তায় শনাক্ত করা যায়
  2. Fetal MRI: ফুসফুসের বিকাশ মূল্যায়ন

৫.২ জন্মের পর (Postnatal)

  1. Chest X-ray: ফুসফুসে বায়ুর বদলে অন্ত্রের ছায়া
  2. Echocardiogram: হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা অবলোকন
  3. CT/MRI: ছিদ্রের অবস্থান ও অঙ্গের স্থান চিহ্নিতকরণ

৬. চিকিৎসা পদ্ধতি (Treatment)

৬.১ নবজাতকের ক্ষেত্রে (Congenital Diaphragmatic Hernia - CDH)

  1. Intensive Care Unit (NICU): জন্মের সাথে সাথে নবজাতককে NICU তে স্থানান্তর করতে হবে।
  2. Ventilator বা ECMO ব্যবহার: শ্বাস-প্রশ্বাস সচল রাখতে সহায়তা করে, বিশেষত যদি শিশুর ফুসফুস দুর্বল থাকে।
  3. অস্ত্রোপচার: শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল হলে ডায়াফ্রামের ছিদ্র বন্ধ করে অঙ্গগুলো সঠিক স্থানে ফিরিয়ে আনা হয়।

৬.২ বড়দের ক্ষেত্রে (Acquired Diaphragmatic Hernia - ADH)

  1. অস্ত্রোপচার: ছিদ্র বন্ধ করা হয় ও অঙ্গগুলো স্বাভাবিক জায়গায় ফেরত আনা হয়।
  2. ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি: কম ইনভেসিভ পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহৃত হয় জটিল রোগীদের ক্ষেত্রে।

৭. জটিলতা (Complications)

  1. Pulmonary hypoplasia: ফুসফুস পূর্ণভাবে বিকাশ না পাওয়া
  2. Persistent pulmonary hypertension (PPHN): ফুসফুসে রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া
  3. শ্বাসকষ্ট এবং ঘন ঘন ইনফেকশন: শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যার সাথে সংক্রমণের ঝুঁকি
  4. Gastroesophageal reflux: হজমের সমস্যায় খাদ্যনালীতে অ্যাসিড ফিরে আসা
  5. Neurological delay: মানসিক ও শারীরিক বৃদ্ধি বিলম্বিত হওয়া
Related Posts

৮. পূর্বাভাস (Prognosis)

সঠিক সময়ে চিকিৎসা ও দক্ষ চিকিৎসকের সহযোগিতায় অধিকাংশ নবজাতক CDH নিয়ে জন্ম নিলেও সুস্থ জীবন ফিরে পায়। সাফল্য নির্ভর করে:

  1. ফুসফুস কতটুকু গঠিত হয়েছে
  2. ECMO ব্যবহার প্রয়োজন হয়েছে কিনা
  3. অস্ত্রোপচারের পরবর্তী যত্ন ও ফলোআপ

প্রায় ৭০–৮০% শিশুরা অস্ত্রোপচারের পর বেঁচে থাকে এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। তবে তাদের দীর্ঘমেয়াদী মনিটরিং প্রয়োজন হতে পারে।

৯. সচেতনতা ও প্রতিরোধ

  1. গর্ভকালীন নিয়মিত আল্ট্রাসাউন্ড ও স্বাস্থ্যপরীক্ষা
  2. বংশগত ইতিহাস থাকলে সতর্কতা
  3. পরিবেশগত ঝুঁকি যেমন ইনফেকশন, ঔষধ ব্যবহার সীমিতকরণ
  4. গর্ভাবস্থায় পুষ্টি ও চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা

১০. বাবা-মায়ের করণীয়

  1. নবজাতকের অস্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস খেয়াল করা
  2. শ্বাস নিতে কষ্ট হলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া
  3. CDH ধরা পড়লে ভয় না পেয়ে NICU ও শিশুর সার্জন চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হওয়া
  4. অস্ত্রোপচারের পর শিশুকে নিয়মিত ফলোআপে রাখা

১১. চিকিৎসার পর যত্ন ও মনিটরিং

ডায়াফ্র্যামেটিক হার্নিয়ার অস্ত্রোপচারের পর একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে নিয়মিত মনিটরিং এবং পরবর্তী যত্ন। অনেক সময় শিশু জন্মের পরই NICU তে ভর্তি হয় এবং ECMO বা ভেন্টিলেশনের সহায়তায় শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। অপারেশনের পর শিশুদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে কিছু বিষয় গুরুত্বপূর্ণ:

  1. ফলো-আপ চেকআপ: অস্ত্রোপচারের পর শিশুদের নিয়মিত চিকিৎসক দ্বারা পরীক্ষা করানো জরুরি।
  2. নিউরোলজিক মনিটরিং: অনেক শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশে বিলম্ব হতে পারে, তাই বিশেষজ্ঞ পরামর্শে থেরাপি দরকার হতে পারে।
  3. শ্বাস-প্রশ্বাসের ট্র্যাকিং: ফুসফুসের বিকাশ ঠিকভাবে হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য নিউমোলজিস্ট বা শিশু ফুসফুস বিশেষজ্ঞের ফলোআপ প্রয়োজন।
  4. পুষ্টি ও হজম: অনেক সময় শিশুরা GERD (গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স) ভোগে, ফলে খাবার ঠিকমতো হজম না হওয়া বা ওজন না বাড়া দেখা দিতে পারে।

১২. দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব

যদিও অনেক শিশু অস্ত্রোপচারের পর সুস্থ হয়ে ওঠে, তবুও কিছু ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন:

  • শ্বাসজনিত সমস্যা: ফুসফুস পুরোপুরি না গঠিত হলে শ্বাসকষ্ট দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
  • মানসিক ও আচরণগত বিকাশে বিলম্ব: অক্সিজেনের ঘাটতির কারণে নিউরোডেভেলপমেন্টাল সমস্যা হতে পারে।
  • খাদ্য গ্রহণ ও ওজন বৃদ্ধিতে সমস্যা: খাদ্য গ্রহণে অনীহা বা গ্যাস্ট্রিক সমস্যা দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হয়ে উঠতে পারে।
  • পুনরায় হার্নিয়ার ঝুঁকি: অস্ত্রোপচারের পর কিছু ক্ষেত্রে ছিদ্র আবার খুলে যেতে পারে।

১৩. শিশু বিকাশে সহযোগিতা

শিশুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে এবং তাদের পূর্ণ বিকাশ নিশ্চিত করতে কিছু বিষয় কার্যকর:

  1. Speech therapy: অনেক শিশু দেরিতে কথা বলা শুরু করে।
  2. Occupational therapy: দৈনন্দিন কাজ শেখাতে সহায়ক হতে পারে।
  3. Physiotherapy: গঠনগত সমস্যা থাকলে তা সমাধানে ভূমিকা রাখে।
  4. Parent counseling: বাবা-মায়ের মানসিক শক্তি বজায় রাখা জরুরি।

১৪. সফলতার গল্প

বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার শিশু CDH নিয়ে জন্ম নিয়েও সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে বর্তমানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সফলভাবে অস্ত্রোপচার করা যায় এবং শিশুর জীবন বাঁচানো সম্ভব হয়। অনেক শিশুই স্কুলে যায়, খেলা করে এবং অন্যদের মতোই বেড়ে ওঠে।

এই সফলতার পেছনে রয়েছে দ্রুত রোগ নির্ণয়, দক্ষ চিকিৎসা দল, এবং সচেতন পরিবার। তাই আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত ও নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা।

১৫. উপসংহার

ডায়াফ্র্যামেটিক হার্নিয়া একটি গুরুতর জন্মগত বা অর্জিত রোগ হলেও চিকিৎসাযোগ্য। গর্ভকালীন সময়ে সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করা গেলে এবং জন্মের পর পর দক্ষ চিকিৎসা ও সার্জারির মাধ্যমে অধিকাংশ শিশুই সুস্থ হয়ে উঠতে পারে। সচেতনতা, সময়মতো চিকিৎসা গ্রহণ এবং পরবর্তী যত্ন শিশুর ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে পারে।

যদি আপনার শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দেয়, দেরি না করে শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করুন। আপনার দ্রুত পদক্ষেপই শিশুর জীবন বাঁচাতে পারে।

মনে রাখবেন, আপনার সচেতনতা আপনার সন্তানের জন্য আশীর্বাদ।

About the author

Daud
Hey! I'm Daud, Currently Working in IT Company BD. I always like to learn something new and teach others.

Post a Comment

To avoid SPAM, all comments will be moderated before being displayed.
Don't share any personal or sensitive information.